দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছেন সত্তরোর্ধ রশিদা বেগম। রক্তশূন্যতাজনিত কারণে তার শরীরে প্রতি সপ্তাহে ‘ইপয়েটিন’ নামে একটি ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এতদিন কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হলেও সম্প্রতি একই কোম্পানির ইনজেকশন প্রয়োগ করা হলে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
রশিদা বেগমের ব্যবহৃত ইনজেকশন ‘ইপয়েটিন-৫০০০ আইইউ’ মূলত এরিথ্রোপয়েটিন গ্রুপের একটি ওষুধ। বাংলাদেশে অন্য কোম্পানির মধ্যে এ গ্রুপের ওষুধ বিপণনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিবার ইনসেপ্টার এই ইনজেকশন ব্যবহারে ওই বৃদ্ধা অসুস্থ না হলেও, এবার কেন?
রশিদা বেগমের ছেলে রাকিবুল ইসলাম উজ্জ্বল জানান, ইনজেকশন দেয়ার পর রশিদা বেগমের খিচুনি শুরু হয় এবং পক্ষপাতগ্রস্ত রোগীর মতো আচরণ করতে থাকেন। এ অবস্থায় আগের ইনজেকশনের সঙ্গে নতুন ইনজেকশন মিলিয়ে উজ্জ্বল দেখেন, দুটি একই কোম্পানির ইনজেকশন হলেও তাদের কাঠামোগত এবং মোড়কে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
বিশেষ করে আগের কেনা ইনজেকশনের মোড়ক খোলার যে অংশে বাংলায় ইপয়েটিন লেখা, সেখানে রেজিস্টার্ড মার্ক অর্থাৎ ক্ষুদ্র গোল বৃত্তে ইংরেজিতে ‘আর’ বর্ণের একটি চিহ্ন রয়েছে। অন্যদিকে নতুন কেনা ইপয়েটিনের মোড়কে এই চিহ্ন দুটি। এ বিষয়ে ইনসেপ্টার কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে আলাপ করে উজ্জ্বল নিশ্চিত হন, দুটি আর চিহ্নের রেজিটার্ড মার্ক দেয়া ইপয়েটিন মূলত নকল।
মোড়ক খোলার অংশে গোল বৃত্তেে ইংরেজিতে লেখা ‘আর’ বর্ণের ইনজেকশন আসল আর দুটি আর বর্ণেরটা নকল। ছবি: সময় সংবাদ
উজ্জ্বলের অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সময় সংবাদের অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু উজ্জ্বল একা নন, নকল ইপয়েটিনের ভুক্তিভোগী অনেক কিডনি রোগী। বিশেষ করে যারা ডায়ালাইসিস, তীব্র ডায়াবেটিকস বা মারাত্মক রক্তশূন্যতার রোগী তাদের মৃত্যুঝুঁকির বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইনসেপ্টা কোম্পানির নামে বাজারে ছড়ানো নকল ইনজেকশনটি।
কোথায় বিক্রি হচ্ছে নকল ইপয়েটিন?
সময় সংবাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে দুবছরের বেশি সময় ধরে বিক্রি হচ্ছে নকল ইপয়েটিন ইনজেকশন। দেশে দেড় কোটির বেশি ডায়াবেটিকস এবং সাড়ে তিন কোটির বেশি কিডনিজনিত রোগীর অনেকেই ক্রান্তিকালে ভরসা করেন এ ইনজেকশনের ওপর। অথচ জীবনরক্ষাকারী এ ইনজেকশন নকল হওয়ায় রোগীর সুস্থতা দূরের কথা, দেখা দিয়েছে জীবননাশের শঙ্কা।
অভিযোগ রয়েছে, শুধু রাজধানীর ছোটখাটো কোনো ফার্মেসি নয়, লাজফার্মা বা তামান্না ফার্মেসির মতো বড় বড় ফার্মেসিতেও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে নকল এই ইপয়েটিন।
ভুক্তভোগী উজ্জ্বল নিজেই গুলশান-১ এর তামান্না ফার্মেসি থেকে নকল ইপয়েটিনটি কিনেছিলেন। তার দাবি, তামান্না ফার্মেসির ওই শাখায় অভিযোগ দিলে, তারা উজ্জ্বলকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭০ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়।
রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর লাজফার্মার দোকানে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে এই ইনজেকশন কেনার পর দেখা যায়, এটিও নকল। নকল ইপয়েটিন কোথা থেকে পেল জানতে চাইলে বিক্রয়কর্মী রফিক বলেন, ‘খোদ ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধিরা ইনজেকশনটি তাদের সরবরাহ করেছেন।’
একই অবস্থা মুগদা মেডিকেল কলেজের সামনের সানজিদা ও লাজফার্মার ফার্মেসিতেও। দুটি দোকানেই মিলেছে নকল ইপয়েটিন। এ ব্যাপারে বিক্রয়কর্মীরা জানিয়েছেন, ইনসেপ্টার কর্মীদের থেকে তারা সরাসরি এ ওষুধ কিনেছেন।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আশপাশের প্রায় প্রতিটি ফার্মেসি ঘুরে একই ধরনের নকল ইনজেকশন পাওয়া যায়। তারাও জানায়, ইনসেপ্টার কর্মীরাই তাদের নকল ইনজেকশন সরবরাহ করেছেন।
তামান্না ফার্মেসির ‘ছলচাতুরি’
নকল ইপয়েটিন বিক্রি প্রসঙ্গে তামান্না ফার্মেসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন মৃধা সময় সংবাদকে জানান, তার ফার্মেসিতে নকল ইনজেকশন বিক্রির কথা জেনেছেন। তবে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি। একইসঙ্গে ভুক্তভোগী উজ্জ্বল তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন বলে জানান মৃধা। যা বেআইনি বলেও দাবি তার।
বাঁয়ে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের আসল ইনভয়েস আর ডানে নকল ইনভয়েস। ছবি: সময় সংবাদ
তামান্না ফার্মেসি কেন ইনসেপ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি জানতে চাইলে মৃধা বলেন, ‘সেলসের যে ছেলেটি ডেলিভারি দেয়, সে আমার পা ধরে কান্নাকাটি করায় প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নিইনি। এরমধ্যে আমি ঢাকার বাইরে চলে আসায় বিস্তারিত কিছু আর জানি না। তবে ঢাকা ফিরে একটা ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’
সরেজমিনে গুলশান-১ এর তামান্না ফার্মেসিতে গেলে মোড়ক খুলে নকল ইপয়েটিন ইনজেকশন বিক্রির প্রমাণ মেলে। যেখানে স্পর্শকাতর ইনজেকশনটি ঝাঁকুনি খায় এমন অবস্থায় বিক্রি করা নিষেধ, সেখানে মোড়ক খুলে তামান্না ফার্মেসি কীভাবে গ্রাহকদের কাছে ইপয়েটিন বিক্রি করে এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মৃধা।
নকল ইনজেকশন বিপণনে কারা জড়িত?
সময় সংবাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফার্মেসির অবহেলা এবং বিক্রয়কর্মীদের প্রতারণার ফসল বাজারে সয়লাব হয়ে যাওয়া ইনজেকশন নকল ইপয়েটিন।
এ বিষয়ে লাজফার্মার বনশ্রী শাখা সময় সংবাদকে জানায়, ইনসেপ্টার জেষ্ঠ্য মেডিকেল প্রমোশন অফিসার সুনীল হালদার থেকে তারা ইনজেকশনটি নিয়েছেন। সুনীল হালদারকে ফোন করে বারবার লাজফার্মায় আসতে বলার পরও তিনি অপরগতা প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে সুনীল হালদারের বাসায় গেলে দেখা যায়, তার বাসায় ইনসেপ্টার অসংখ্য মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এসবের পাশাপাশি তার থেকে ইপয়েটিনের তিনটি ইনজেকশনও পাওয়া যায়, যা নকল।
সুনীলের দাবি, তিনি সরাসরি ইনসেপ্টা থেকে ইনজেকশন না নিয়ে মুগদা মেডিকেলের সানজিদা ফার্মেসি থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় কিনেন। সুনীলকে নিয়ে সানজিদা ফার্মেসিতে খোঁজ চালালে সেখানে আরও পাঁচটি নকল ইনজেকশন খুঁজে পাওয়া যায়।
সানজিদা ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী জানান, উত্তম নামে ইনসেপ্টার আরেক মেডিকেল প্রমোশন অফিসার তাদের এ ইনজেকশন সরবরাহ করেছেন। নকল ইনজেকশনের বিষয়ে ফার্মেসির কর্মী এবং সুনীল একে অন্যকে দোষারোপ করেন। এক পর্যায়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজের কথা বলে সুনীল সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়েন।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে আয়ান ফার্মেসিতে একই ধরনের নকল ইনজেকশন পাওয়া গেলে তারা জানান, মোহাম্মদ পলাশ নামে ইনসেপ্টার ওষুধ সরবরাহ কর্মী তাদের ইপয়েটিনগুলো দিয়েছেন।
ফার্মেসিতে ডেকে এনে বিষয়টি জানতে চাইলে পলাশ বলেন, ‘ইনসেপ্টা থেকে নিজে গিয়ে এ ইনজেকশন এনেছেন। পরবর্তীতে আবার জানান, তিনি নিজে ডিপো থেকে না নিয়ে ইনসেপ্টারই আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার থেকে নকল ইপয়েটিন এনেছেন।
পলাশকে নিয়ে ইনসেপ্টার অফিসে যাওয়ার কথা বললে দ্রুত ফার্মেসি থেকে পালিয়ে যান তিনি। শাহবাগ এলাকার ইনসেপ্টার এরিয়া ম্যানেজার মোহাম্মদ মিজানকে নকল ইনজেকশনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইপয়েটিন ইনজেকশনের ডেলিভারি সম্পর্কে কিছুই জানি না। এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।’
ইনজেকশনের সিলের অংশটি আসলটিতে কালো এবং নকলটিতে হালকা ছাই রঙের। ছবি: সময় সংবাদ
কর্মীদের নকল ইনজেকশন কেনাবেচার বিষয়ে জানতে ইনসেপ্টার প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করে সময় সংবাদ। কোম্পানির নামে নকল ইনজেকশন বিক্রির সঙ্গে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা সবাই ইনসেপ্টার কর্মী বলে নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আসল ইপয়েটিন ও নকল ইপয়েটিন পাশাপাশি নীরিক্ষা করে দেখান ইনসেপ্টার মার্কেটিং স্ট্রাটেজি বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ডা. গোলাম রিয়াদ চৌধুরি। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে দেখেই মনে হচ্ছে ফার্মেসিতে যে ইপয়েটিন বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো নকল। মোড়ক এবং ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দেখেই আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত ইংরেজি বর্ণের দুটি আর রেজিস্টার্ড মার্ক করা ইপয়েটিন ইনসেপ্টার প্রস্তুতকৃত না।’
রিয়াদ আরও বলেন, ‘এর বাইরে সিরিঞ্জের গায়ে ওষুধের পরিমাণ নির্ণয়ের যে দাগকাটা অংশটি রয়েছে সেটি দেখেও বোঝা যাচ্ছে এটি ইনসেপ্টার প্রস্তুত করা নয়। আসল ইপয়েটিনের দাগকাটা অংশটি খোদাই করা এবং নকলটি রঙ দিয়ে কিংবা কিছুক্ষেত্রে স্টিকারের ওপর লেখা। অন্যদিকে ইনজেকশনের সিলের অংশটি আসলটিতে কালো এবং নকলটিতে হালকা ছাই রঙের।’
নকল ইপয়েটিন কী করে ইনসেপ্টার কর্মীরা বিক্রি করছেন জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের জানা ছিল না বাজারে ইনসেপ্টার এ পণ্য নকল বিক্রি হচ্ছে এবং আমাদের কর্মীরাই এখানে জড়িত। আমার মনে হচ্ছে, একটি বড় চেইন সিন্ডিকেট এর পেছনে রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেব।’
সুনীল কী করে ২ হাজার টাকা বেশিমূল্যের ইনজেকশন ১ হাজার ৪০০ টাকায় কেনেন? এ বিষয়ে রিয়াদ বলেন, ‘বাজারে এই ইনজেকশন ১ হাজার ৯০০ টাকার নিচে বিক্রি করার কোনো উপায় নেই। ১ হাজার ৪০০ টাকায় যেটি বিক্রি হচ্ছে সেটি আর যাই হোক ইনসেপ্টার প্রস্তুত করা ইপয়েটিন না।’
এ ধরনের নকল ইনজেকশন ব্যবহারে রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে রিয়াদ বলেন, ‘আমাদের শঙ্কা শুধু রাজধানী না, সারা দেশে নকল এ ইনজেকশন ছড়িয়ে পড়েছে। ইনসেপ্টার যেসব কর্মী এ কাজের সঙ্গে জড়িত দ্রুত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এরইমধ্যে ওষুধ প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। দ্রুত ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে ইনসেপ্টা সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
কিছুই জানে না ওষুধ প্রশাসন!
যেখানে কিডনির নকল ইনজেকশনে সয়লাব বাজার, সেখানে ওষুধ প্রশাসনের কাছে এ নিয়ে কোনো অভিযোগ রয়েছে কি না জানতে চাইলে সময় সংবাদকে তারা বলেন, তাদের কাছে ইপয়েটিন ওষুধ নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। এমনকি বাজার নকল ইপয়েটিনে সয়লাব, এ ব্যাপারেও তারা জানেন না।
ইনসেপ্টা এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছে কি না জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক আসরাফ হোসেন বলেন, ‘ইনসেপ্টা এখন পর্যন্ত ওষুধ প্রশাসনকে কিছুই জানায়নি। বাজারে কোনো কোম্পানির নকল ওষুধ বের হলে সবার আগে কোম্পানিটির উচিত ওষুধ প্রশাসনকে জানানো। সেখানে ইনসেপ্টা কিছু না জানিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে।’
এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসনের পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে আসরাফ আরও বলেন, ‘সারা দেশে ওষুধ প্রশাসনের ৫২টির মতো টিম রয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব তাদের মাঠে অভিযানে পাঠানো হবে। যেসব ফার্মেসিতে নকল ওষুধ পাওয়া যাবে তাৎক্ষণিক জব্দ করা হবে। সেইসঙ্গে মামলাও দেয়া হবে।’
নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক বলেন, ‘নকল ওষুধ কোথায় কোন ঝুপরিতে তৈরি হচ্ছে সেটি দ্রুত খুঁজে বের করা মুশকিল। তবে ইনসেপ্টার উচিত যেসব কর্মী এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা।’
বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৫:০৩ ১৪৯ বার পঠিত