
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক সূচকের দ্বৈত চাপে আছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, অর্থনীতির সংগ্রাম চলছে, জীবিকার সংগ্রামও চলছে। তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত, সেটা হয়নি। আবার আরো ভালোও হতে পারত—সেটাও হয়নি।
তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এমন অবস্থায় আছে যে, ‘এই গাড়ি, নির্বাচনের মেট্রো—চালু হয়ে গেছে।
বড় ধরনের ছয় বা তার বেশি মাত্রার রাজনৈতিক ভূমিকম্প যদি না হয়, এই মেট্রোটা থামানো সম্ভব হবে না।’
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ২০২৫ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২৫’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক সূচক আছে—রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন উচ্চতায় উঠেছে, অর্থপাচারে ভাটা পড়েছে, রাজস্ব আদায়ে কিছু গতি এসেছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। প্রাকৃতিক ঝাঁকিতে অর্থনীতি নড়েছে, কিন্তু তাকে গ্রাস করতে পারেনি। এগুলোই ইতিবাচক ছবির অংশ। অন্যদিকে নেতিবাচক সূচকগুলো আরো ভারী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার মতে, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে উঁচু, প্রকৃত মজুরি নিম্নমুখী, কর্মসংস্থান অপরিবর্তিত, রপ্তানির গতি ইদানীং কিছুটা কমেছে এবং বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক দারিদ্র্য মূল্যায়নের উল্লেখ করে তিনি বলেন, দরিদ্র এবং নতুন দরিদ্র—দুই ধরনের মানুষের সংখ্যাই বেড়েছে।
ড. জাহিদ বলেন, এই পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায় যে সার্বিকভাবে অর্থনীতি সংগ্রাম করছে, জীবিকার সংগ্রামও চলছে। তবে তিনি যোগ করেন, এর চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। আবার আরো ভালোও হতে পারত—সেটাও হয়নি।
পরিস্থিতি আরো খারাপ না হওয়ার তিনটি কারণ তুলে ধরেন তিনি। প্রথম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক রেজিলিয়েন্স খুব শক্তিশালী, যার বড় উদাহরণ ২০২৪ সালের ৫-৮ আগস্টের তিন দিন—যখন রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রায় অকার্যকর ছিল, তবু অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আগের মতো ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক গালাগাল চললেও এখন তা তুলনামূলক ভদ্র ভাষায় হচ্ছে। তিনি এটিকে একটি উল্লেখযোগ্য কালচারাল চেঞ্জ হিসেবে দেখেন। তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করা হলেও সেটাই তাদের নিরপেক্ষতার একটি প্রমাণ।
বড় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের ‘মেট্রো ট্রেন’ ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। বড় ধরনের ছয় বা তার বেশি মাত্রার রাজনৈতিক ভূমিকম্প না হলে এই ট্রেন থামানো সম্ভব নয়।
তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পূর্বে যে আত্মঘাতী আচরণ ছিল, সেখানে একটি মন্দা চলছে। এই ‘মন্দা’কে তিনি ভালো বলেই মনে করেন এবং চান এটি স্থায়ী হোক।
সংস্কার নিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সবাই মনে করেছে যে ইচ্ছা থাকলে সংস্কার সম্ভব। কিন্তু গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তার মন্তব্য হলো—ইচ্ছা থাকলেই উপায় হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। ইচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্ট্যামিনাও প্রয়োজন। স্ট্যামিনা না থাকলে সংস্কার কম্পিউটারের মতো হ্যাং হয়ে যায়।
তিনি বলেন, অসংখ্য কমিশন, কমিটি, রিপোর্ট, কর্মশালা—এসবই সদিচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু হাতেগোনা অর্ডিন্যান্স ও সিদ্ধান্ত ছাড়া বাস্তব সংস্কারের বড় ফলাফল এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তার মতে, ইচ্ছা ও স্ট্যামিনা—উভয়ই একসঙ্গে না হলে সংস্কার এগোবে না এবং তখন ভালো ফলও আসবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:১৫:৪৯ ৬ বার পঠিত