
গৃহবধূকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের ঘটনায় অবশেষে মামলা নিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানা পুলিশ।
শুক্রবার এ,এসপির নির্দেশের পর মামলা নেয়নি ওসি’ শিরোনামে গৃহবধূ মিনা খাতুনের ওপর হওয়া লোমহর্ষক নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহর নজরে আসে।
তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মিনা খাতুনকে নির্যাতনকারী গোদাগাড়ী পৌরসভার ২ নং কাউন্সিলর ও এলাকার মাদক সম্রাট মোফাজ্জল হোসেন মোফাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ডের নির্দেশ দেন।
তিনি আগেই এই মামলা রেকর্ডের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারপরও কেন তা হয়নি, সেই বিষয়ে ওসিকে ভর্ৎসনা করেন।
এ দিকে পুলিশ সুপারের কঠোর নির্দেশের পর শুক্রবার সকালে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ নির্যাতনের শিকার গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি মহল্লার বানী ইসরাইল ভোদলের স্ত্রী নির্যাতনের শিকার মাদারপুর মহল্লার একটি বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা গৃহবধূ মিনা খাতুনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান।
শুক্রবার সকালে মিনা খাতুন বাদী হয়ে মোফাজ্জল হোসেন মোফা, তার ছেলে রবিউল ইসলাম রবি ও মেয়ে ঝরণাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের একটি মামলা রেকর্ড করেন।
মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে গোদাগাড়ী থানার ওসি খাইরুল ইসলাম বলেন, মিনা খাতুন বাদী হয়ে এজাহার দিলে পুলিশ সেটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করেছেন। মামলা রেকর্ডের পরপরই পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চালায়। তবে আসামিরা টের পেয়ে পালিয়েছে বাড়ি থেকে।
উল্লেখ্য মোফাজ্জল হোসেন মোফা পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহিষালবাড়ি মহল্লার পাতু নাপিতের ছেলে। থানা পুলিশের দালালি ছাড়াও এলাকার মাদক সম্রাটদের কাছ থেকে টাকা তুলে পুলিশকে ম্যানেজ করাই তার মূল কাজ। এ ছাড়া মোফা একাধিক মামলা সিন্ডিকেটের সঙ্গেও জড়িত। ২০১৫ সালে পুলিশ একটি হেরোইন চোরাচালান মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার করে।
অভিযোগে জানা গেছে, গত ৩ মে দুপুরে নিজেদের মিনা খাতুনের সঙ্গে তার শাশুড়ী ডলি বেগমের কথা কাটাকাটি হয়। এই ঘটনার জের ধরে মোফা কাউন্সিলর ডলি বেগমের পক্ষ নিয়ে মিনা খাতুনকে ঘর থেকে বের করে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে বেদম মারধর করেন। বিবস্ত্র অবস্থায় বাড়ির আঙ্গিণায় ফেলে মোফার ছেলে রবি ও মেয়ে ঝরণা খাতুন, মিনার মুখে নাকে ও পেটে লাথি মারতে থাকলে এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মোফাজ্জল হোসেন মোফা এই সুযোগে মিনার ঘরে থাকা কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।
এদিকে এলাকাবাসী মিনাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে গোদাগাড়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করেন। সেখানে ডাক্তাররা মিনাকে ভর্তি করে নিয়ে চিকিৎসা দেন। পরদিন ৪ মে মিনা কিছুটা সুস্থ হয়ে থানায় মামলা করতে গেলে ওসি মামলা না নিয়ে ফিরিয়ে দেন।
পরে ন্যায়বিচারের আশায় মিনা গত ৬ মে রাজশাহীর এসপি মো. শহীদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। এসপি মিনার শরীরে নির্যাতনের দগদগে চিহৃ দেখে তাৎক্ষণিকভাবে মামলা রেকর্ড ও আসামি গ্রেফতারের নির্দেশ দেন থানার ওসিকে।
এদিকে গোদাগাড়ীর পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবুসহ কয়েকজন সহযোগী মোফার পক্ষ হয়ে মামলা করতে না দিয়ে মীমাংসার কথা বলে গত ৭ মে মিনাকে জোর করে থানা থেকে তুলে নিয়ে আসে। ৮ মে পৌর কার্যালয়ে বসা শালিসে মোফাকে অভিযুক্ত করে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এই জরিমানার ৪০ হাজার টাকা মিনার স্বামীকে দেয়া হয়। বাকি টাকা ভাগাভাগি করেন শালিসকারীরা।
এদিকে এসপির কাছে যাওয়া ও থানায় মামলা করতে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মোফা ও তার সহযোগী মাদক ব্যবসায়ীরা মিনাকে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেন। না গেলে দুই সন্তানসহ তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলে জানায়। ফলে ৯ মে মিনা তার দুই সন্তানকে নিয়ে মাদারপুর মহল্লার এক বাড়িতে আত্মগোপন করেন।
অবশেষে শুক্রবার দৈনিক যুগান্তর-এ মিনার নির্যাতনের বিস্তারিত ঘটনা প্রকাশের পর পুলিশ সুপার দ্রুত মিনাকে উদ্ধার করে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড ও গ্রেফতারে থানার ওসিকে পুনরায় নির্দেশ দেন। জানা গেছে মামলা হওয়ার পর থানা পুলিশ মিনা খাতুনকে তার নিজের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন।
মিনা খাতুন বলেন, এসপি সাহেবের এই দয়া আমি জীবনে ভুলব না। উনি হস্তক্ষেপ না করলে হয়তো আমি মামলা করতে পারতাম না। এসপি সাহেব আমাকে বলে দিয়েছেন তার কোন সমস্যা হলে যেন আমি সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫০:০০ ১৫০ বার পঠিত