রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই মোবাইল ফোন চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ এ মাধ্যমটি খুইয়ে অসহায় হওয়া ভুক্তভোগীদের কেউ থানায় অভিযোগ করেন, অনেকে ঝামেলা এড়াতে চুপ থেকে যান। তবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে চোরাই ও ছিনতাই হওয়া অনেক মোবাইল ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ কাজে। আবার চোরাই মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে একটি বাসায় গড়া হয়েছিল মাইক্রোস্কপি কম্পিউটার ল্যাব। যেখানে বসে দুটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে চোরাই মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করা হতো।
গত ২৩ আগস্ট এমন একটি চক্রের সন্ধান পেয়ে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের ‘স্পেশাল অপারেশনস টিম’ মাতুয়াইল এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন- মো. সাইদুল ইসলাম (২১) ও তৌহিদুল ইসলাম (৩৮)। পরদিন তাদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা হয় মামলা (মামলা নং-১০৫)।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই এলাকায় একটি বাসার ৬ষ্ঠ তলায় সন্ধান মেলে একটি কম্পিউটার ল্যাবের। যেখানে বসে সিএম২ ও সিগমা নামক দুটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হতো চোরাই ও ছিনতাই করা মোবাইলের আইএমইআই নম্বর।
সেখান থেকে জব্দ করা হয়- একটি মাইক্রোস্কপি, কম্পিউটার (১টি মনিটর, ১টি সিপিইউ), ২টি ল্যাপটপ, ১৯টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল (এর মধ্যে ৫টি মোবাইল প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে), ১টি মোবাইলের আনলক করার সিএম২ সফটওয়্যার ডিভাইস ও ১টি আইএমইআই পরিবর্তনের সিগমা সফটওয়্যার ডিভাইস, ৪টি ডাটা ক্যাবল, ১টি পাওয়ার মেশিন, ১টি হিটার মেশিন এবং ১টি রাউটার।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে একই চক্রের সদস্য আরো পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- সোহেল রানা (২৯), রানা শেখ (২৮), বেলাল হোসেন রাসেল (২৫), আমির হোসেন (৫৪) এবং মো. রবিন (৩০)।
গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার সাইদুল ইসলাম ও তৌহিদুল ইসলাম চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনকারী চক্রের মূল সদস্য। সাইদুল ইসলামের আপন ভাই পলাতক সাইফুল ইসলামসহ চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সিমএম২ ও সিগমা সফটওয়্যারের মাধ্যমে কৌশলে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে আসছিল। এর বেশিরভাগই যাচ্ছিল বিভিন্ন অপরাধীদের হাতে।
গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের স্পেশাল অপারেশনস টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. আফসার উদ্দিন খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পলাতক সাইফুলসহ চক্রটির গ্রেপ্তার সাইদুল ও তৌহিদুল সরাসরি চোরাই মোবাইলের কারবার ও আইএমইআই পরিবর্তনে জড়িত। তাদের এই কারবারে চুরি ও ছিনতাইয়ের মোবাইল সাপ্লাই দেয় বাকি পাঁচজন।
চোরাই মোবাইল সরবরাহের সাপ্লাই চেইন জড়িত রয়েছে আরও অনেকে। তারা ঢাকার বিশেষ করে বাসস্ট্যান্ড, মেডিকেল, হাসপাতাল, মসজিদ, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ীর মতো জনবহুল এলাকায় গাড়ি ও রাস্তায় মোবাইল ছিনতাই ও চুরি করতো। এরপর তা তারা দিতো সাইদুল ও তৌহিদুলের হাতে। তারা পলাতক সাইফুলসহ ল্যাবে বসে সেসব মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করতো।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছে, চক্রটি গত এক বছর ধরে এভাবে চোরাই মোবাইলের কারবার করছিল। চক্রের সদস্যরা প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টি চোরাই ও ছিনতাই করা মোবাইল ফোন সরবরাহ করতো চক্রের মূল তিন সদস্যের হাতে। প্রায় প্রতিদিন ল্যাবে বসে তারা গড়ে ২০-২৫টি মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রি করে দিতো।
এব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, ছিনতাই করা মোবাইল ফোনের বেশিরভাগ অপরাধ কাজে ব্যবহার ও দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়। কখনো আবার নজরদারি এড়াতে চুরি কিংবা ছিনতাই করা মোবাইলফোন ছিনতাইকারীরা অনেক দিন বাসায় ফেলে রাখে। আবার কমদামি চোরাই মোবাইল বিক্রি করে দিতো ফুটপাতে।
সম্প্রতি কয়েকজন মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারি, সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছিনতাই করা বা চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে সিএম২ ও সিগমা নামক সফ্টওয়্যার। দুটিই পেইড সফটওয়্যার। যা ব্যবহার আইনত অপরাধ।
তিনি বলেন, তিনজন ভুক্তভোগী থানায় জিডি করেন। সেটি তদন্ত করতে গিয়ে দেখতে পাই দুটি ফোন শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ধারণা করা হয় আইএমইআই পরিবর্তন করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার ও মোবাইল উদ্ধারের পর স্পষ্ট হয় আইএমইআই পরিবর্তন করা হয়েছে। এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় চোরাই মোবাইল শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের স্পেশাল অপারেশনস টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. আফসার উদ্দিন খাঁন বলেন, মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করতে গিয়ে তারা আন্দাজে কিছু নম্বর বসিয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে অন্য বৈধ ব্যবহারকারীর মোবাইল ফোনের আইএমইআই-এর সঙ্গে মিলে যায়। এক্ষেত্রে জটিলতা হলো অনেক অপরাধে জড়িতরা পার পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় ও নিরীহ কেউ কেউ ভোগান্তির শিকার হন। এমনও হয়েছে যে, ভুয়া আইএমইআই-এর সূত্র ধরে অপরাধীকে ধরতে গিয়ে জানা যায়, বৈধ ব্যবহারকারী এর কিছুই জানেন না। তখন আমাদের অন্য বিকল্প পন্থায় ক্রস চেক করে তা নিশ্চিত হতে হয়।
চক্রের মূল তিন সদস্যের একজন সাইফুল এখনো পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তার সাতজনকে আদালতের নির্দেশে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৫২:৩৩ ৯৬ বার পঠিত