
জামালপুর প্রতিনিধি : দেশের অন্যতম প্রাচীন জামালপুর পৌরসভায় জলাবদ্ধতা এখন আর কোনো মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং এটি এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। একসময়ের বর্ষাকালের এই সমস্যা এখন সারা বছরের সংকটে রূপ নিয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন জমে থাকা পানিতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পৌরসভা দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় পার করলেও শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মতো একটি মৌলিক সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিয়মিত কর পরিশোধ করা হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে পৌর কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
শহরের পিটিআই এলাকার বাসিন্দা সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা মঞ্জু জানিয়েছেন, তার বাড়ির আশেপাশে প্রায় এক ফুট পানি জমে থাকে। ভারী বৃষ্টি হলে এই জলাবদ্ধতা দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে ড্রেন পরিষ্কার না করার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
শহরের পালাশগড় এলাকার প্রায় ২০০ পরিবার বছরের বেশিরভাগ সময় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। তাদের প্রধান প্রবেশপথটি পানির নিচে থাকায় রোগী আনা-নেওয়া, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, জমে থাকা এই নোংরা পানি বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের জন্ম দিচ্ছে, যা বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গত এক দশকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। হ্যাচার, কাজির আখ ও পালাশগড় এলাকার অন্তত ১০০ হেক্টর উর্বর জমি এখন স্থায়ীভাবে পানির নিচে, যা কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদে ঢেকে গেছে।
কৃষক মঈন উদ্দিন জানান, গত ১০ বছরে তিনি তার প্রায় ৩০০ একর আবাদি জমি থেকে এক ফোঁটা ফসলও তুলতে পারেননি।
কৃষক ফারহাদ হোসেনের মতে, অপরিকল্পিত বাইপাস সড়ক নির্মাণের কারণে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই রাস্তাগুলো বাঁধের মতো কাজ করে জমিতে পানি আটকে রাখছে।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করে বলেন, শহরের প্রধান নিষ্কাশন পথ হিসেবে পরিচিত গোবা ও বানিয়াবাজার খাল দুটি বছরের পর বছর ধরে দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। ফলে অতিরিক্ত পানি সরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। শেখের ভিটার একটি কালভার্ট কিছু অসাধু ব্যক্তির মাটি ভরাট ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছে। এর ফলে শান্তিনগরে মানুষের ঘরে ঘরে হাঁটুসমান পানি ঢুকে যায়।
জামালপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসন জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছে বলে দাবি করেছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রধানদের সাথে বৈঠক হয়েছে এবং দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, প্রস্তাবটি দ্রুত উচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। তবে স্থানীয়দের মধ্যে এই আশ্বাসে ভরসা কম। তাদের মতে, অতীতেও অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো সমাধান আসেনি।
এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা পরামর্শ দিয়েছেন, যদি কৃষিজমি আর আবাদযোগ্য না থাকে, তাহলে মালিকদের সম্মতিক্রমে সেগুলোকে মৎস্য প্রকল্পে রূপান্তর করা যেতে পারে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ জানিয়েছেন, জামালপুরের জেলা প্রশাসক, পৌরসভা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সম্মিলিতভাবে এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজছে।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জামালপুর পৌরসভার প্রশাসক এ কে এম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ ডিসি কাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচের ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আসন্ন বর্ষাকালে পুরো জামালপুর শহর ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে শহরবাসীর সচেতনতা এবং পৌর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা উভয়ই অপরিহার্য।
বাংলাদেশ সময়: ২১:০৬:৪৯ ৯৬ বার পঠিত