![]()
বিচারকদের অনেক অভিমতই রাষ্ট্র ও ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে অসামান্য ভূমিকা রাখে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
আগামী ২৭ ডিসেম্বর দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের আগে আজ দেয়া বিদায়ী অভিভাষণে তিনি একথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই সত্য অস্বীকার করা যায় না যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্বে, বিচার বিভাগ অসাংবিধানিক ক্ষমতা, অপশাসন ও রাষ্ট্রীয় কপট-কৌশলের অঘোষিত সহযোগী হিসেবেও পরিগণিত হয়েছে। দুঃশাসনের বলয়কে আবরণ দিয়েছেন অনেক বিচারক। অন্যায় ও অবিচারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিচারকদের এই নৈতিক বিচ্যুতি জনসাধারণকে শেষ পর্যন্ত জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার অন্যতম অনুঘটক বলে আমি মনে করি।
অভিভাষণে উপস্থিত সারা দেশের বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন ও পাঠাভ্যাসকে যেন আপনারা জীবনের পরম দায় হিসেবে গ্রহণ করেন। অধ্যয়ন, গবেষণা ও বিচারচর্চার অভিজ্ঞতা - উন্নয়নে নিজেকে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রাখুন। কেবল কর্মসম্পাদন নয়, বরং কর্মের উৎকর্ষ অন্বেষাই হোক আমাদের সকল প্রচেষ্টার প্রাথমিক ভিত্তি। প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে এসে আমি আপনাদেরকে সমাজ, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার জগতে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে অনুরোধ করি। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ শাখা যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পরিবেশ-বিজ্ঞান, সাইবার নিরাপত্তা এসবেও নিজেদের বিচরণ বৃদ্ধি করুন। কেননা, একজন বিচারক হিসেবে আমরা কখনোই নিশ্চিত থাকতে পারি না, মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক কোন ঘটনা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হবে এবং কখন সেটি আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে? জীবনযাত্রার কোন স্তর থেকে, কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে, অভূতপূর্ব সব প্রশ্ন আদালতের দ্বারস্থ হবে এবং আমাদের বিচারবোধ ও বিচক্ষণতাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করবে? তাই সব রকমের জ্ঞান ও সমাজের প্রতিটি স্পন্দন যেমন আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রায় লিখনে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি বিচারকদের অনেক অভিমতই রাষ্ট্র ও ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণেও অসামান্য ভূমিকা রাখে।’
ঐতিহাসিক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, পৃথক সচিবালয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে এদেশের আপামর জনসাধারণের সাংবিধানিক সকল অধিকার সুরক্ষিত করার প্রধান নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকদের দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় অন্যায়ের জন্য এখন থেকে অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ বন্ধ করতে হবে। জনগণের জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ে সুবিচার নিশ্চিত করতে শতভাগ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পছন্দসই পদায়নের জন্য রাজনৈতিক পদলেহন পরিহার করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আইন বৃহত্তর রাজনীতির একটা অঙ্গ হলেও, বিচারকদেরকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠার প্রয়াস রপ্ত করতে হয়। কেবল ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণির পক্ষে প্রয়োজনীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব নিলে বিচার বিভাগের আলাদা কোনো অস্তিত্বেরই প্রয়োজন নেই। সে কাজের জন্য নির্বাহী বিভাগ ও পুলিশই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি যে আদর্শকে ধারণ করেই গড়ে উঠুক না কেন, বিচারকদেরকে সুনীতি ও সুবিবেচনা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আজকের এই সমাপনী অভিভাষণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, দেশের সকল জেলার জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ০:০১:৪৯ ৯ বার পঠিত