মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বাইক্কাবিলে পরিযায়ী ও দেশিয় জলচর পাখি বেড়েছে। দুই দিনব্যাপী পাখিশুমারি শেষে এই তথ্য জানিয়েছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থম্পসন।
তিনি জানান, এবছর বাইক্কাবিলে ৩৯ প্রজাতির জলচর পাখির দেখা মিলেছে। বিলে পাওয়া গেছে ১৯ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এই পরিযায়ী পাখির সঙ্গে মিলেমিশে আছে আমাদের দেশের ২০ প্রজাতির জলচর পাখি। বাইক্কাবিলে ২০১০ সালের পর এবারই বেশি জলচর পাখির দেখা মিলেছে, বলেন পাখি গনণাকারী এই বিশেষজ্ঞ। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটায় শ্রীমঙ্গলে সিএনআরএস কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাইক্কাবিল প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন।
তিনি বলেন, এর আগে ২০১০ সালে এই বিলে ৪০ প্রজাতির ১২ হাজার ২৫০ টি পাখির দেখা মিলেছিল। এবার ৩৯ প্রজাতির ১১ হাজার ৬১৫টি পাখির দেখা মিলেছে।
পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থম্পসন গত ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কাবিলে অবস্থান করে পাখি গণনা করেন। এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস’র অধীনে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব বাইক্কাবিলে এই পাখিশুমারী করে।
ড. থম্পসন জানান, ২০০৪ সালে বাইক্কাবিল প্রতিষ্ঠার পর ওই বছরের জুলাই মাস থেকে বিলটিকে পাখিশুমারির আওতায় আনা হয়। ওই বছরে মোট ২৯৬ টি জলচর পাখি বাইক্কাবিলে আসে। ২০১৮ সালে এই বিলে ৩৮ প্রজাতির ৫ হাজার ৪১৮টি পাখির দেখা মিলেছিল। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ৪১ প্রজাতির ১০ হাজার ৭১৩টি পাখির দেখা পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে বাইক্কাবিল অভয়াশ্রমে পরিযায়ী ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৮ হাজার ৮৩২টি এবং ২০১৫ সালে গনণাকালে ৬ হাজার ৯৯১টি জলচর পাখির দেখা মিলে।
পল বলেন, এসব শুমারী জলাভূমির সূচক অনুযায়ী শুধুমাত্র জলচর পাখিকেই গণনার আওতায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়। তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাইক্কবিলে মোট এক হাজার ১৭৪টি জলচর পাখি আসে, ২০০৬ সালে আসে ছয় হাজার ৯৪৯টি, ২০০৭ সালে সাত হাজার ২০৪টি, ২০০৮ সালে ছয় হাজার ৪২৯টি, ২০০৯ সালে নয় হাজার ৪০৫টি, ২০১০ সালে ১২ হাজার ২৫০টি, ২০১১ সালে পাঁচ হাজার ৯৮৯টি, ২০১২ সালে তিন হাজার ৯৬৪টি, ২০১৩ সালে সাত হাজার ৪৯৯টি, ২০১৪ সালে ১০ হাজার ৪৭৯টি পরিযায়ী ও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখি বাইক্কাবিলে আসে।
প্রতিবছর একই সময়ে বিলে পাখির সংখ্যা কম বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ড. পল থম্পসন বলেন, বাইক্কাবিল অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পর সেখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। এই কাজগুলো সাধারণত শীত মৌসুমে করা হয়। যখন পরিযায়ী পাখিরা আসা শুরু হয়। যে সব বছরে বিলে কাজ করা হয়েছে ওইসব বছরে পাখির সংখ্যা কমে গেছে।
তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখিরা আসার আগে এরাও আবাসস্থলটি নিরাপদ কিনা সিটি বিবেচনায় রাখে। কোনো বছর যদি বিলে মানুষের উৎপাত বেড়ে যায় তবে পরের বছর ওই বিলে পরিযায়ী পাখির আসা কমে যায়। কারণ এরা ভাবে এই আবাস নিরাপদ নয়। এছাড়াও পরিযায়ী পাখিরা যখন যেখান থেকে আসে সেই পথের সার্বিক অবস্থার উপরও এই বিষয়টি নির্ভর করে।
জলাভূমির বাহ্যিক অবস্থা, গভীরতা, জলজ উদ্ভিদের পরিমাণ, খাদ্যের প্রাপ্যতা- এসব বিষয়ও পরিযায়ী পাখিরা বিবেচনায় নেয় মাইগ্রেশনের জন্য। এসব কারণে পাখি বছরে বছরে কম বেশি হয়।
পল থম্পসন বলেন, এ বছর বাইক্কবিলে খয়রা কাস্তেচরা নামের পরিযায়ী জলচর পাখিটি বেশি এসেছে। যা আর কোনও সময় আসেনি। ৪-৫ বছর আগে বাংলাদেশে এই পাখিটির দেখা মেলেনি। এখন প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে দেশের জলাভূমিতে। এবছর বাইক্কাবিলে এই প্রজাতির ২৮৮টি পাখির দেখা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী পাখি এসেছে গেওয়ালা বাটান। এবছর ২ হাজার ২৮০টির দেখা মেলেছে। এছাড়া বাইক্কাবিলে অন্য যেসব পাখির দেখা পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- পাতি তিলিহাঁস ২ হাজার ২২০টি, ল্যাঞ্জাহাঁস ৯২১ট, রাজ সরালী ৩৯৮টি, পাতি সরালী ৮৬০টি।
এই বিলে বিপন্ন পাঁচ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। এদের মধ্যে আছে বড়গুটি ঈগল, পালসী কুড়াঈগল, উদয়ী গয়ার, কালা মাথা কাস্তেচড়া ও মরচেং ভূতিহাঁস।
এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস, সাউথ এশিয়ার আওতায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পাখিপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণে প্রতিবছর মধ্য জানুয়ারিতে এই পাখিশুমারী করা হয়।
বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এই শুমারী হয়। এরমধ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর, কুলাউড়ার হাকালুকি হাওর, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, উপকূলীয় অঞ্চলের নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়া, সন্দ্বীপসহ আরও কিছু এলাকা রয়েছে।
শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওর প্রসঙ্গে ড. পল থম্পসন বলেন, যেভাবে হাইল হাওরের বাইক্কাবিলের পার্শ্ববর্তী প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। মাছের খামার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। প্লাবনভূমি অর্থাৎ উন্মুক্ত জলাভূমির ব্যাপ্তি সংকুচিত হচ্ছে। এতে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের পাশাপাশি হাওর এলাকায় প্রজনন ক্ষেত্র হারিয়ে যাচ্ছে। দেশিয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। স্থানীয় দারিদ্র জনসাধারণ তাদের জীবন জীবিকার জন্য বিভিন্ন ধরণের সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে কিছু সংখ্যক বিত্তশালী লোক তাদের প্রভাব খাটিয়ে সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। এ থেকে উত্তরণে সরকার এবং স্থানীয় জনসাধারণ একসাথে হয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৮:২৫ ৪৪১ বার পঠিত