
নিউজটুনারায়ণগঞ্জ: ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানলাভের আকাঙ্ক্ষা আর এক মাস ১০ দিন হাসপাতালে কাটানোর কষ্ট ঘুচিয়ে কন্যা সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম বীণা।
ঘর আলোকিত করে আসা নতুন অতিথি নাম রাখা হয়েছে ইয়োনা। সেই সঙ্গে পুরো ঘরে আলো ছড়িয়েছে নবজাতকটি। মা-বাবার সঙ্গে দাদা-দাদির মুখেও ফুটেছে হাসি। সন্তান ও ইউএনওর জন্য দোয়া চেয়েছে পরিবার।
একমাত্র সন্তান ইয়োনার জন্মের শুরু থেকেই উৎকণ্ঠা ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয়েছে মা হোসনে আরা বেগম বীণাকে। অবশ্য সন্তানকে কোলে নিয়ে সব দুঃখ ভুলে গেছেন মা। সন্তানের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।
এরই মধ্যে মা এবং সন্তানের জন্য দোয়া চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ইউএনও হোসনে আরার এক নিকটাত্মীয়। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘মহান আল্লাহর রহমতে দীর্ঘ এক মাস ১০ দিন পর আমার ইয়োনা মামণি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে। সবাই আমার মামণির দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন। মা ও সন্তানের জন্য দোয়া করবেন সবাই।’
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীণা বলেছিলেন, ‘নারী হিসেবে ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চিকিৎসার পরও যখন সন্তান লাভ করতে পারিনি তখন পাঁচ মাস আগে জানতে পারি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমি। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নির্বাচনের কাজ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি। এর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বাহবা পেয়েছি। নারী কর্মকর্তা হিসেবে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একজন বিশেষ কর্মকর্তা বিভিন্ন মহলে পাঁয়তারা করছিলেন আমাকে বদলি করার জন্য।’
ওই স্ট্যাটাসে ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীণা আরও লেখেন, ‘আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রেগুলার চেকআপ করতে আমি হাসব্যান্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি। চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমরা হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য, এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায় আমার সদাশয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে। আমার অপরাধ হলো আমি সন্তানসম্ভবা। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো, সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘খবরটা শোনার পর আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি। আমি অ্যাজমার রোগী। প্রচণ্ড মানসিক চাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।’
‘আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কী অপরাধ ছিল? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানি না। তবে জানি একজন সব দেখেন, তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের ওপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোনো কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলব, তুমি এর বিচার করো। আর যারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন। ও সুস্থ হয়ে গেলে কোনো কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।’
ইউএনওর আবেগঘন ওই স্ট্যাটাস নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে তুমুল আলোচনা হয়। ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে বিষয়টি। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীণার ওএসডির আদেশ বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৪:৫০ ২৫৫ বার পঠিত