রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘১৯৭১, বাংলাদেশে গণহত্যা: দায়বদ্ধতা ও স্বীকৃতি’ শীর্ষক সেমিনারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হওয়া গণহত্যার স্বীকৃতি স্বরূপ ২৫শে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে। সোমবার (২৫ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে এ দাবি জানিয়ে উপস্থিত বক্তারা বলেন, ‘বিশ্বের বুকে পরবর্তীতে যেনো কোন শাসক গোষ্ঠী এমন গণহত্যার সাহস না পায় সে জন্য ২৫ মার্চ দিনটির স্বীকৃতি এবং হত্যাকারীদের বিচার হওয়া জরুরি’।

১৯৭১ সালে অক্সফামের হয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী নিয়ে কাজ করেন ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আমি কখনো ১৯৭১ সালকে ভুলতে পারব না। এখনো মাঝে মাঝে ভোর বেলা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি দেখি, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আছি আমি এবং আমার হাতে এক শিশুর লাশ’।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বছর মার্চ এবং ডিসেম্বর মাসে আমাকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চলা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে বলা হয়। আমার পরিচিত মানুষ বা এদেশ থেকে অনেকেই বলেন লেখার জন্য। কিন্তু আমি কি লিখব? একই কথা কি বারবার লেখা যায়? আসলে একই কথা বারবার লিখতে হয়। বারবার জানাতে হয়। পরিকল্পনা কমিশনের এক ওয়ার্কশপে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ ১৯৭১ সালের পর জন্ম গ্রহণ করেছে। তাই বারবার সত্য ইতিহাস তুলে ধরে এই মানুষদের স্মরণ করানো গুরুত্বপূর্ণ’।

জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ‘গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সেমিনারে আমরা অংশ নেই যেখানে খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। যেখানে চীফ গেস্ট ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এদিন পাকিস্তানে একটি বই লঞ্চ করা হয়েছিলো। সেখানে তাকে পাকিস্তানে প্রকাশিত বইটি দেখানো হয় যার নাম ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’। জুনায়েদ খানের লেখা এই বইয়ে দাবি করা হয়, গণহত্যার কাহিনী অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করেছে মুক্তিবাহিনী। এ বিষয়ে তোফায়েল আহমেদের সাথে কথা হয় এবং এরপর ঐ দিনই পার্লামেন্টে তিনি বইটি নিয়ে সন্ধ্যায় উপস্থিত হন। তারপর পয়েন্ট অব অর্ডারে নিজের হাত তুলে তিনি এমন এক দাবি তোলেন যা নিয়মিত দাবি ছিলো। কিন্তু সেভাবে পালন করা হয়নি। আর তা হল, মার্চ মাসের ২৫ তারিখকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। আর এভাবে এ দেশে জাতীয় ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে’।

২৫শে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার উপযুক্ত সময় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি পাওয়া একটু কঠিন। কেননা ভিন্ন ভিন্ন পার্লামেন্টে এ বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আমরা এ বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করতে পারি। যেখানে বাংলাদেশের তিনজন এমপি রয়েছেন। এরপর বিশ্বের অন্যান্য পার্লামেন্টেও কাজটি শুরু করা যায়। এভাবেই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিলো’।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফারহাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবা ‘৭০ এর নির্বাচনে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু রাজাকাররা খুলনা তাকে আটক করে। এরপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি’। এ সময় তার অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সেমিনার কক্ষ ভারি হয়ে ওঠে। নিজ আসন ছেড়ে তার কাছে পানি নিয়ে পৌঁছে দেন স্পেনের অ্যাম্বাসেডর অ্যালভারো দে সালাস জেমিনেজ দে আজসারাতে।

২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হন ড. নুজহাত চৌধুরীর বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিমুজ্জামান চৌধুরী। তিনি তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আপনারা আজ ১৪ ডিসেম্বরে হত্যা হওয়া বুদ্ধিজীবীদের যে ভিডিও দেখেছেন সেখানে আমার বাবাও আছেন। ৪৮ বছর পর এখন আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাইছি। তাকে যে হত্যা করা হয়েছে এর স্বীকৃতি চাইছি’।

সেমিনারের শেষভাগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা সম্ভব নয় যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে স্বীকৃতি না দেয়। আমরা আশা করছি, তারা আমাদের পাশে থাকবে। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টায় ভাটা পরে’।

অনুষ্ঠানে ইকবাল সোবহান চৌধুরী, লে কর্নেল ফারুক খান, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক অ্যাম্বাসেডর জমির এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী পরিবারের আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৬:২৫   ১৮৪ বার পঠিত