উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সততা ও সাহসের সঙ্গে প্রভাবশালী একটি চক্রকে মোকাবেলা করায় শেষ পর্যন্ত সরকারের ৫৬৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হল। এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
ফলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের (প্রথম ফেজ) কাজ বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় ছাড়াও বড় বাধা দূর হয়েছে।
যারা নানামুখী প্রেসার সৃষ্টি করে কাজটি বেশি দরে হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দরপত্রের কার্যক্রম পরিচালনার ওপর হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশকে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি স্থগিত করে দেয়ায় দরপত্র উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে সংকট কেটে গেছে। একই সঙ্গে যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য ফাঁস করার সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাও চিহ্নিত হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র জানায়, প্রকল্পটির কাজ পেতে মোট ৯টি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়। ৬ ফেব্রুয়ারি দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের কারিগরি মূল্যায়ন করা হয়।
এত ২টি কোম্পানি রেসপন্সিভ হয়। কোম্পানি দুটি হল বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) ও অপরটি জেভি হিসেবে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই)। ১৩ ফেব্রুয়ারি দরপত্রের ফাইনান্সিয়াল অফার উন্মুক্ত করার কথা ছিল।
কিন্তু এর আগেই এনডিই দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়নের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে ওই দরপত্র প্রক্রিয়ার পরবর্তী সব কার্যক্রম স্থগিত করেন।
এই আদেশ স্থগিত চেয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেবিচকের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে জরুরিভিত্তিতে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দেন। একই সঙ্গে আবেদনটি ২৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে হাইকোর্টের আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত হওয়ায় দরপত্র প্রক্রিয়ার পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
সূত্র জানায়, চেম্বার জজ আদালতের আদেশের পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বুধবার দরপত্রের ফাইন্যান্সিয়াল দর উন্মুক্ত করে। এতে প্রদত্ত দর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হাইকোর্টে রিটকারী প্রতিষ্ঠান এনডিই’র দর সর্বনিু দরদাতার চেয়ে ৫৬৫ কোটি টাকা বেশি।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় সরকার। ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রথম দরপত্রে অংশ নেয়া কোনো কোম্পানিই রেসপন্সিভ হয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহবান করলে ৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী। অন্যদিকে রিট আবেদনকারী এনডিই’র পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ এবং এএম আমিন উদ্দিন ও মাহবুব শফিক।
জানা গেছে, সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক এবং বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান যৌথভাবে প্রচেষ্টা চালান।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের কেনাকাটায় সরকারি অর্থ সাশ্রয় ও অপচয় দূর করতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অনুশাসন রয়েছে। সেজন্য তারা প্রকল্পের শুরুতে রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের টাকা নয়ছয় করার আলামত আঁচ করতে পেরে কঠোর অবস্থান নেন।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিলেটের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। বিদেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই বিমানবন্দরের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র বেশিরভাগই সিলেটে।
শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ সহজলভ্য হওয়ায় সিলেটে শিল্প-কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীর পাশাপাশি কার্গো মুভমেন্ট কয়েকগুণ বেড়েছে। বর্তমানে এই বিমানবন্দরে ১২ হাজার ১০০ বর্গমিটারের একটি টার্মিনাল ভবন, ৭৫০ বর্গমিটারের কার্গো ভবন এবং একটি রানওয়ে আছে। এর পাশাপশি দুটি ট্যাক্সিওয়ে, চারটি ছোট ও দুটি বড় প্লেন পার্কিং সুবিধাসহ এর শেড, দুটি বোর্ডিং ব্রিজ, দুটি এস্কেলেটর আছে।
কিন্তু যাত্রী পরিবহনে এগুলো যথেষ্ট ছিল না। যার কারণে প্রতিনিয়ত এই বিমানবন্দরে কার্গো ও যাত্রী পরিবহনে হিমশিম খেতে হচ্ছিল সংশ্লিষ্টদের। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে এই বিমানবন্দরে ৩৪ হাজার ৯১৯ বর্গমিটারের অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
এছাড়া কার্গো ভবন, কন্ট্রোল টাওয়ার, পার্কিং, ট্যাক্সিওয়েসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে ২ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার।
প্রকল্পের আওতায় একটি ফায়ার স্টেশন, কন্ট্রোল টাওয়ার, প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক ভবন, ডরমেটরি, আনসার ব্যারাক ও রেস্ট হাউস নির্মাণ করার কথা রয়েছে। সড়ক, কারপার্ক ও ফুটপাতের উন্নয়নসহ কেনা হবে নয়টি যানবাহন এবং দুটি অগ্নিনির্বাপণ গাড়িও কেনার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:১২:১১ ২৩৮ বার পঠিত