‘ভোটার হয়ে ভোট দেব, দেশ গড়ায় অংশ নেব’- এই স্লোগান নিয়ে মাত্র দুদিন আগেই পালিত হলো ভোটার দিবস। র্যালি আর আলোচনা সভায় ভোটারদের সম্মান আর মর্যাদার বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরা হলেও বাস্তবে সেই ভোটারদেরই ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা নেই নির্বাচন কমিশনে (ইসি)।
জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনীর ক্ষেত্রে এই জনভোগান্তি ইসি সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। দুই দিনেই যেই কাজটি সমাধান পাওয়ার কথা সেই কাজটিই দুই বছর ঘুরেও করে নিতে পারছেন না নাগরিকরা। ইসির এই সেবা কার্যক্রম জনমানুষের পৌঁছানোর লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলোকে আবেদন গ্রহণ ও সংশোধিত কার্ড প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে ইসি। অথচ সেই অফিসগুলোতেই বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের।
টাকা ছাড়া আবেদন ইসির সার্ভারে জমাই হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে দেশজুড়ে। টাকা দিলেও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখে কার্ড পাচ্ছেন না এমন অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। এক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের দোষ দিচ্ছেন। সার্ভার ঠিকভাবে কাজ করে না বলে নাগরিকদের জমাকৃত আবেদনের হালনাগাদ অবস্থাটিও জানাতে পারেন না তারা।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জনভোগান্তির ই বিষয়টিকে পাত্তা তো দেনই না, বরং এটিকে তারা এখন উপভোগ্য একটি বিষয়ে বলে ধরে নিয়েছেন। সার্ভারের দোহাই দিয়ে এসব কর্মকর্তা পার পাওয়ার চেষ্টা করলেও তারা নিজেরাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেন না বলে অভিযোগ রয়েছে প্রচুর ভোটারের।
অবশ্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, নাগরিকরা যাতে ভোগান্তির শিকার না হয়, এ জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। এনআইডি উইংয়ের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনীর আবেদন করা ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন কিছু চা ল্যকর ভুলের তথ্য পাওয়া গেছে যা সত্যিই অভাবনীয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সংশোধনীর জন্য প্রথমে উপজেলা নির্বাচন অফিসের একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রয়োজন হয়। আর তদন্ত প্রতিবেদন টাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। প্রথমত, উপজেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, পিয়নদের টাকা না দিয়ে সংশোধনীর আবেদন জমা দিলে সেই আবেদন মাসের পর মাস উপজেলা অফিসে পড়ে থাকে। টাকা দিলেই আবেদন সার্ভারে আপলোড করা হয়। এরপর তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
জন্ম সাল সংশোধনীর ক্ষেত্রে প্রতি বছরের জন্য দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। কেউ যদি এনআইডি কার্ডে ১০ বছর বয়স সংশোধন করতে চান, তবে তাকে ১ লাখ টাকারও বেশি দিতে হয়। এ টাকার ভাগ উপজেলা-জেলা এবং ইসির ঢাকা অফিস পর্যন্ত দিতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভোটারের হয়রানির বিষয়ে খোদ ইসির এক কর্মকর্তা জাতীয় পরিচয়পত্রে বিভিন্ন ভুলের ভয়াবহ তথ্য দেন। তিনি জানান, দুই সহোদর ভোটারের ভোগান্তির কথা। এই কর্মকর্তা বলেন, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দুই ভোটার এসেছিলেন তার কাছে সংশোধনীর বিষয়ে। তারা দুই ভাই ভোটার হয়েছেন একই সঙ্গে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে শুধু দুই ভাইয়ের ছবিই আলাদা। নাম, জন্ম সাল, জন্ম তারিখ সবই এক। গাইবান্ধার এক ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে তার চেয়ে তার মায়ের বয়স দুই বছর কম দেখানো হয়েছে। কিভাবে এসব হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিরাজগঞ্জের এক ভোটার জানান, ২০১৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পান তিনি। পরিচয়পত্র হাতে পেয়ে দেখেন জন্ম সালসহ অনেক তথ্য ভুল। ভুল সংশোধন করতে গিয়ে পড়েন মহাবিপদে। ভোটার তথ্য ফরমে তাকে বিবাহিত দেখানো হয়েছে। এমনকি স্ত্রীর নামও দেয়া হয়েছে। এই সংশোধনীর জন্য দলিল হিসেবে তার কাছে চাওয়া হয় তালাকনামা। তিনি এখনো বিয়ে করেননি, তালাকনামা পাবেন কই? ইসির মাঠ কর্মকর্তাদের এমন ভুলে সর্বনাশ হয়েছে এই ভোটারের। তিনি সরকারি চাকরির আবেদন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন।
আবেদনে বিবাহিত দেখালেও সমস্যা, আবার না দেখালেও সমস্যা। কেননা পরিচয়পত্র যাচাই করলে ইসির সার্ভারে বিবাহিতের তথ্য দেখতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। আবার চাকরির আবেদনেই বা তিনি কীভাবে বিবাহিত লিখবেন? এমন উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি।
এসএসসি পাস একজন ভোটার জানান, এসএসসি সনদ অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯৮ সালে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুলক্রমে তা দেখানো হয় ১৯৮৮ সাল। এই সংশোধনীর জন্য নিজ উপজেলায় আবেদন জমা দিয়েছেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধনীর জন্য দলিল হিসেবে দিয়েছেন এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট জন্ম সনদ, পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ ও চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র। আবেদন জমা দেয়ার সময় কার্ড দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেয়া হয় ওই সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কিন্তু আবেদন জমা দেয়ার দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও তার আবেদনের অবস্থা কী এখনো তিনি জানতেই পারিননি। কবে এই সংশোধিত কার্ড হাতে পাবেন বা আদৌ পাবেন কিনা তাও জানেন না ভোগান্তির শিকার এই ভোটার।
বান্দরবনের একজন নারী ভোটার জানান, তার পরিবারের সবাই স্মার্টকার্ড পেয়েছে। কিন্তু তার কার্ডের কী অবস্থা তা জানাতে পারছে না ইসির কর্মকর্তারা। তিনি জানান, ইসির স্থানীয় অফিসে অনেকবার খবর নিতে গিয়েছেন। কিন্তু তারা বলেছেন, ঢাকা অফিসে খবর নিতে। আর ঢাকা অফিসের কেউ সহযোগিতাও করছে না। এ রকম অভিযোগ দেশের শত সহস্ত্র নাগরিকের। এ বিষয়ে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক বলেন, আগে এনআইডির কাজ কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় ছিল। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশনের আ লিক, জেলা ও উপজেলা অফিস থেকে করা হচ্ছে। সেবাটা মানুষের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার চেষ্টা করছি। হারানো আইডি মানুষ অনেক দ্রুত সময়ে পাচ্ছেন। কিন্তু সংশোধনীর বিষয়টি অনেক সংবেদনশীল। তাই খুব নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এর আগে অনেকেই অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করেছে।
সুত্র মানবকণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৮:১৪ ১১৫ বার পঠিত