মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে তার স্মৃতির ভাণ্ডার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার সে অভিজ্ঞতা চলচ্চিত্রেও কাজে লাগিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা জানিয়েছেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তার অভিনীত ও প্রযোজিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি এখনও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ছবি। ২৬ মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের ‘হ্যালো…’ বিভাগে কথা বলেছেন তিনি
২৬ মার্চের সময়টি কেমন ছিল আপনাদের কাছে?
সোহেল রানা: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই চূড়ান্তভাবে যুদ্ধে নেমেছিলাম। ২৫ মার্চ রাতের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। শুধু ২৫ মার্চই কেন, যুদ্ধকালীন প্রতিটি রাতই আমাদের কাছে ছিল কালরাত্রি। স্বীকৃত ওই কালরাত্রির পর পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। হায়েনাদের হাতে প্রিয় মানুষদের হত্যার শোক আমাদের কাছে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সে শক্তিতে বলীয়ান হয়েই যুদ্ধ করেছি আমরা। স্বাধীন করি দেশ।
আপনার সংগ্রামী জীবন কখন থেকে শুরু হয়েছিল?
সোহেল রানা: আমার সংগ্রামী জীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে। তখন আমি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। ওই সময় দুটি রাজনৈতিক দল ছিল- একটি ছাত্র ইউনিয়ন, অপরটি ছাত্রলীগ। ১৯৬৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হই। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগের ভিপি ছিলাম। টানা ১৯৭২ থেকে ৭৪ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করি।
মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি এখনও আপনার সামনে জ্বলজ্বল করে?
সোহেল রানা: মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনাই এখনও স্পষ্ট আমার কাছে। শুধু একদিনের ঘটনার কথা বলি। সারা রাত হেঁটে খুব ক্লান্ত হয়ে কেরানীগঞ্জের আটি বাজারের কাছে গেলাম। তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। আমার বন্ধু মোস্তফা মহসিন মন্টু বলল, দেখ কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমরা গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে বের হতাম। কারণ চাদরের আড়ালে স্টেনগান থাকত।
আমরা হাঁটছিলাম খাবারের সন্ধানে। একটি বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম কতগুলো মুরগি ছোটাছুটি করছে। কিছু মুরগি বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হল, এ বাড়িতে অনেক মুরগি রয়েছে। হয়তো ডিমও পাওয়া যাবে। হাতে যা পয়সা আছে তা দিয়ে ডিমগুলো কিনে নিলে আমরা খেতে পারব। বাড়িতে ঢুকে এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা। তাকে বললাম, ‘মা, আমাদের কাছে কিছু ডিম বিক্রি করবেন’?
তিনি বললেন, ‘বাবা ডিম তো নেই।’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরপর আমি মন খারাপ করে চলেই আসছিলাম। দশ-বিশ কদম হাঁটার পর ঘুরে আবার পেছন দিকে তাকালাম। দেখি একটি লোক ওই মহিলার কাছ থেকে দুটি ডিম নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই আমার খুব রাগ হল। গায়ের চাদর সরিয়ে বন্দুক দেখালাম। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম ডিম থাকা সত্ত্বেও আমাকে দিলেন না কেন? মহিলা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ডিম কোথায়?’ আমি বললাম, ‘এইমাত্র আপনি ওই লোকটিকে ডিম দিলেন, তখন মহিলা বললেন, ‘ওইটা তো ডিম নয়। আমি ওকে বদা দিয়েছি।’ ডিমকে ওরা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বদা’ বলত। বুঝলাম, ডিম বলাতে মহিলা সেটি কী জিনিস চিনতে পারেননি। পরে ওই মহিলা আমাদের ত্রিশটি ডিম দিয়েছিলেন। কোনো দাম নেননি। ডিমগুলো এনে আমরা সিদ্ধ করেছি। একটি করে ডিমও আমাদের ভাগে পড়েনি। অর্ধেক করে খেয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের পর ‘ওরা ১১ জন’ নামের একটি ছবি প্রযোজনা করেছেন। এরপর নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে আর কোনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি দেখা যায়নি। কেন?
সোহেল রানা: ওরা ১১ জন আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম। ছবিটি মুক্তির পর মানুষের যথেষ্ট ভালোবাসা ও সাফল্য পেল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে তেমন একটা সাধুবাদ পাইনি। স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সোহেল রানা সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হননি কিংবা একটি ধন্যবাদপত্রও পাননি। এতে করে এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে সামনে আগানোর ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেল। তাই আর সেটি নিয়ে কাজ করা হয়নি।
আপনার পর অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি বানিয়েছেন। সেগুলোতে কী সরকারের সহযোগিতা ছিল?
সোহেল রানা: মুক্তিযুদ্ধের গল্পের আবহে অনেক ছবিই তো নির্মিত হয়েছে। সেগুলো প্রায়ই বাণিজ্যিক ছবি। মুক্তিযুদ্ধের আবহ কিছুটা দেখানো হয়েছে তাতে। সেগুলোকে আমি পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলতে পারি না। সরকারের সহযোগিতা করার কিছু দেখিনি সেসব ছবিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৮:৩৯ ৩১৮ বার পঠিত