যেখানে সেখানে ময়লা, আবর্জনা ফেলে রাখার সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিবেশের এই বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল গত ২২ মার্চ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণের স্বীকৃতিপত্র পাওয়ায় সেদিন নানা আনন্দ আয়োজনে এই অনুষ্ঠান পেছানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য জলাশয় রক্ষা, নদী খনন, ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায়ে সরকারের চেষ্টা নিয়ে কথা বলেন। এর মধ্যে উঠে আসে নাগরিকদের যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার বদভ্যাস নিয়েও।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যত্রতত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া। আমাদের সেই সিভিক সেন্স আসেনি। এখনও বাসে যেতে যেতে একটা কিছু খেলাম, ঠাস করে রাস্তায় ফেলে দিলাম।’
‘এটা আস্তে আস্তে বদলাতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে।’
‘এখানে পানিসম্পদ মন্ত্রী আছেন, আগে পরিবেশে ছিলেন, এলজিআরডি মিনিস্টার আছেন, সচিবরা আছেন, আপনাদের সবার কাছে অনুরোধ এ ব্যাপাকে একটু সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাসে বা অন্য গাড়িতে ময়লা ফেলার জায়গা থাকলে মানুষ সেখানে ফেলতে পারবে।
শিল্ক কলকারখানা ও হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘যেখানে জনবসতি, সেখানে হাসপাতাল করা হয়েছে, সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থাই নাই, এটা হলো আমাদের দুর্ভাগ্য।’
‘যারা করেছেন, তারা অনেক জ্ঞানী গুণি ব্যক্তি, তারাই মাঝে মাঝে অজ্ঞানের মতো কাজ করেন, করে যাচ্ছেন।’
এই বদভ্যাসের কারণে নদীও দূষিত হচ্ছে বলে আক্ষেপের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি স্টিমার, লঞ্চ চলাচল করে নদীতে, খেয়েদেয়ে সব বর্জ্যগুলো নদীতেই ফেলা হয়।’
‘এটা এখন শুধু আমার দেশে না, সমগ্র বিশ্বব্যাপী একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা গিয়েছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
দীর্ঘ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টির প্রতিই বেশি গুরুত্বাপোর করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘উন্নয়নের নামে আমরা দেখি সবার আগে পুকুর ভরাট, খাল ভরাট, নদী ভরাট। এই কাজগুলো থেকে সকলবে বিরত থাকতে হবে।’
‘পরিকল্পনা এমনভাবে নেয়া উচিত, আামাদের প্রাকৃতিক যে জলাধারগুলো আছে, যে জলাধারে বর্ষার সময় পানিটা এসে জমা হয়, সেটা সংরক্ষণ করতে হবে।’
‘আমাদের নদীর সাথে সাথে অজস্র খাল থাকে, এই পানি খাল দিয়ে নদীতে যায়। সেটা যেন কোনোদিন বন্ধ না হয়।’
রাজধানীর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার মধ্যে আমি অনেক পুকুর দেখেছি, এখন পুকুরের মধ্য দালান কোটা উঠে গেছে। অথচ পুকুরগুলো রাখা জরুরি ছিল পরিবেশের জন্য।’
‘পুকুরগুলো ঘন বৃষ্টিতে পানি ভরাট হয়, এতে মাটির নিচে পানির স্তরটাও ঠিক থাকে।’
‘আমাদের নদী নালা খাল বিল ভরাট করে নির্মাণ কাজ বা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, এটা থেকে যতদূর সম্ভব আমাদের বিরত থাকতে হবে। আর যদি করা হয় তাহলে যতটা সম্ভব জলাধার সৃষ্টি করতে হবে।’
‘আমরা হাউজিং সোসাইটি করি, শিল্প কল কারখানা করি, শপিং মল করি, যাই করি না কেন, দেখা যায় যেখানে বিল ছিল তা এমনভাবে ভরাট করা হয় যে, সেখানে পানিরই কোনো অস্তিত্ব থাকে না।’
‘যারাই নির্মাণ কাজ করবেন, যারাই প্রকল্প নেবেন, প্রত্যেকটা জায়গায় জলাধার থাকতে হবে আর বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।’
‘আমাদের যত রাস্তাঘাট হবে, সেই রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে কালভার্ট এবং ব্রিজ থাকতে হবে। কোনো মতে পানির গতি যেন থেমে না যায় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় মাটির নিচ থেকে পানি তোলার বিপদের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। আর সরকার ভূ উপরিস্থ পানি ব্যবহারে যে গুরুত্ব দিয়েছে, সেটিও জানান তিনি।
রাজধানীর প্রকট পানি সমস্যার সমাধান করে বিভিন্ন ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট করার বিষয়টিও জানান শেখ হাসিনা। পানি ব্যবহারে মিতব্যয় হওয়ারও তাগাদা দেন তিনি।
নদী ভাঙন সমস্যা সমাধানের জন্য নদী খননকেই সবচেয়ে ভালো বিকল্প মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার নিজের অভিজ্ঞতা, যখন অপর দিকে ডুবোচর জাগে, তখন নদীর চাপটা পড়ে আমাদের পাড়ে। তখনই আমাদের জনপদগুলো ভেঙে যাওয়া শুরু করে।’
‘ডুবোচর যদি কেটে দেয়া যায়, পানির গতিটাকে ওদিকে যদি সরিয়ে আনা যয়, তখনই কিন্তু ভাঙনটা থেমে যায়।’
তবে কিছু দুর্বল এলাকায় বাঁধ দেয়ার পাশাপাশি নদী শাসন করতে হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘সাথে সাথে নদীর স্বাভাবিক গতি যেন কখনও বাধাগ্রস্থ না হয়, সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
গঙ্গা পানি চুক্তির পর গড়াই নদী খননের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলে লোনা পানির প্রবাহ কমে যায়। কিন্তু ২০০১ সালে শেষ অংশটা বাকি ছিল, বিএনপি সেটা বন্ধ করে দেয়। আর এখন সরকার সেটা আবার শুরু করেছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
নদী ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়িয়ে বর্ষায় আসা নদীর অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ, নদীর তীরে পানির বাফার জোন তৈরির পরামর্শও দেন শেখ হাসিনা।
শুধু বাঁধ দিয়ে এই কাজ করা যাবে না জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিন্তাভাবনারও সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় নদী ড্রেজিংয়ের বদলে নদীর পাড় বাঁধাই করা, চার লেনের রাস্তা বানানোর পরামর্শ দেয় জানিয়ে বিরক্তিও জানান প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘রাস্তা বানানোর জন্য সড়ক ও সেতু বিভাগ আছে, তারাই রাস্তা তারা বানাবে। আমাদের ওয়াটার রিসোর্সের রাস্তা বানানোর প্রয়োজন হবে না।’
‘তাদের কাজ হচ্ছে নদীটা ড্রেজিং করা, পলিটার ম্যানেজমেন্ট কীভাবে করবে, নদীর পার বাধাই করে দেয়া।’
ভারতের সাথে আলোচনা চলছে
ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ৫৪ নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা। ৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা সে ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছি, গঙ্গার পানি চুক্তি করেছি।’
‘ভারতের সাথে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন কাজ করেছি, যৌথ নদী কমিশন-জেআরসি গঠন করা আছে।’
‘তারা আলাপ আলোচনা করছে এবং অন্যান্য নদীর সমস্যাটা কীভাবে সমস্যাটা সমাধান করা যায়, আর তিস্তা নিয়েও আলোচনা চলছে।’
‘তবে কারও ওপর নির্ভরশীল না। নিজেদের ব্যবস্থাপনাটাকে নিজেদের করতে হবে। বর্ষাকালে যে বিশাল জলরাশি আসে সেটাকে কীভাবে ধরে রাখতে পারি, আমাদেরকে সেই পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে নিজেদেরটা দেখতে হবে।’
পানিব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ১০০ বছর মেয়াদী ডেল্টা প্ল্যান করার কথাও জানান শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। তাদের বসতি, তাদের কর্মসংস্থান, তাদের খাদ্য নিরাপত্তার কথাও আমাদের চিন্তা করতে হয়। সেটা আমরা কীভাবে করব সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা ডেল্টা প্ল্যানটা গ্রহণ করেছি।’
পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, সচিব কবির বিন আনোয়ার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান প্রমুখ এ সময় বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:২০:২২ ৪৫৭ বার পঠিত