‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ আমাদের সৌভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথের চাওয়া কিংবদন্তির মহানায়ক আমরা পেয়েছি—তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু উদারনৈতিক আদর্শের ধারক। তাঁর স্বভাবসুলভ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি সর্বজনস্বীকৃত। তাঁর উদারতা হিমালয় পর্বতকেও হার মানায়। পারিবারিকভাবে ইসলামী চেতনায় জন্মগ্রহণকারী বঙ্গবন্ধু ইসলামের উদার আদর্শই আজীবন লালন করেছেন। তিনি বিশ্বমানবতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নিপীড়িত ও বঞ্চিতের জন্য দুঃখবোধ করা, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা নেওয়ার গুণাবলি তাঁর কৈশোর ও যৌবনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রেরণাও এসেছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনা থেকে। ক্ষমতায় গিয়েও তিনি সাধারণ কর্মীদের কথা ভেবেছেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার নিভৃত কোণে আমার কর্মী পড়ে আছে, যার জামা নাই, কাপড় নাই। তারা আমার কাছে আসে না। …এদের সাথে আমার রক্তের সম্বন্ধ। আজও আমি দেখি তার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। আমি দেখি, সেই ছেঁড়া পায়জামা, ছেঁড়া শার্ট, পায়ে জুতা নাই। বাংলাদেশে আমার এ ধরনের লক্ষ লক্ষ কর্মী পড়ে আছে।’
প্রত্যহ জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত স্বদেশ ও দেশবাসীর প্রতি আত্মনিবেদনে উন্মুখ ও অবিচল বঙ্গবন্ধু বারবার প্রায় মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলেছেন, আমার দেশের জনসাধারণকে আমি ভালোবাসি, তারাও ভালোবাসে আমাকে। এই বাক্য উচ্চারণের সময় যেন গর্বে স্ফীত হতো তাঁর বুক। বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত অজস্র কিন্তু সেগুলোর সবই আমরা জানি না। আজ বঙ্গবন্ধুর একটি উদারতার কথা লিখছি। সেটি ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনা। ভৈরব ও আশুগঞ্জ সংযোগকারী রেল সেতুর নামকরণ সম্পর্কিত। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা থেকে সিলেট এবং ঢাকা থেকে নোয়াখালী রেল সড়কের মধ্যে মেঘনা নদীর এটি ‘ভৈরব সেতু’ বা ‘ভৈরবের মেঘনা পুল’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। ১৯৩৫-৩৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর অনবরত কাজ করার পর সেতুটি নির্মিত হয়েছিল। এই সেতু দিয়ে প্রথম মালগাড়ি চলাচল শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সেতুর ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেতুর শুভ উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে এই সেতুটি নির্মিত হয় এবং তত্কালীন সরকার রাজা ষষ্ঠ জর্জের নামানুসারে এই সেতুর নামকরণ করেছিলেন ‘কিং জর্জ সেতুু। প্রথম দিকে এই সেতুর পশ্চিম অংশে অর্থাত্ ভৈরবের দিকে লেখা ছিল KING GEORGE VI BRIDGE.
মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে পাকিস্তানি বাহিনি এ দেশের অনেক স্থাপনা ধ্বংস করেছিল। বাঙালি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যে তারা হত্যা করেছে এ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের মাত্র কয়েক দিন আগে নিশ্চিত পরাজয় অনুধাবন করে বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছিল ভৈরব সেতুর কিছু অংশ। ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটের রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ফলে ভারত ও যুক্তরাজ্যের আর্থিক সহযোগিতায় সেতুটি দ্রুত পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং আজও সেই সেতু দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করে। ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মেঘনার পশ্চিম তীরে ভৈরব রেলস্টেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতা কেটে একটি বিশেষ ট্রেনে চড়ে সেতুটি পার হয়ে আশুগঞ্জ স্টেশনে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এই সেতুর নামকরণ নিয়ে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদারতার মহান দৃষ্টান্ত। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেতুর নামকরণ করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আশুগঞ্জ বিদ্যুেকন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পূর্বনির্ধারিত জনসভায় উপস্থিত জনতাও বঙ্গবন্ধুর নামে সেতুটির নামকরণের দাবি জানিয়েছিলেন। জনসভায় উপস্থিত নেতারাও এর নামকরণ ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু সেতু। এমনকি সেতুর নামফলক, ব্যানার, ফেস্টুন পত্রিকার রিপোর্টেও প্রকাশিত হয়েছিল এই সেতুর নাম বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু। কিন্তু সেখানে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেতু উদ্বোধন করতে গিয়ে জানতে পারেন, এখানে যুদ্ধরত অবস্থায় এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন—তাঁর নাম হাবিলদার আবদুল হালিম। এ কথা জানতে পেরে উদার বাঙালির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, এখন থেকে এ সেতুর নাম হবে—‘শহীদ হাবিলদার আবদুল হালিম সেতু’। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসারে সেতুর মূল নাম আজও শহীদ সুবেদার অবদুল হালিম রেলওয়ে সেতু। জানা যায়, শহীদ হাবিলদার আবদুল হালিমের বাড়ি চাঁদপুর জেলার নূরপুরের চণ্ডি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। কসবা এলাকার তত্কালীন ক্যাপ্টেন এবং পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল আইনুদ্দিনের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে বীরবিক্রম উপাধিও দেওয়া হয়।
এ দেশের জনগণ এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন অবিচ্ছেদ্য। তিনি মানুষের, বিশেষ করে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, এ দেশের যেকোনো বাঙালির স্বীকৃতিই তাঁর স্বীকৃতি। নিজের নামে লেখা সেতু ফলকের নাম মুছে দিয়ে অন্যকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব, সহজ, সহজাত। এ কারণেও তিনি বাঙালি জাতির উদারতার মহানায়ক। তাই এত বছর পরও বাঙালি ধন্য, হে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪০:৪০ ১০৪ বার পঠিত