অপহরণ করে গুম এবং নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় স্বজন হারানো পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে, মুক্তিপণের দাবিতে কিংবা অজ্ঞাত নানা কারণে নিখোঁজের সংখ্যা বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ব্যক্তির উদ্ধার কিংবা সন্ধানে যে সর্বাংশে সফল হচ্ছে তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। ফলে বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে সন্তানের জন্য মা-বাবার কান্না, স্বামীর জন্য স্ত্রীর কান্না, ভাইয়ের জন্য বোনের কান্না, বাবার জন্য সন্তানের কান্না বেড়েই চলেছে।
অনেকে কান্নার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। নিখোঁজ ব্যক্তি ফিরে আসবে এ আশায় পথের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক নিখোঁজের স্বজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। অনেকে হয়েছেন শয্যাশায়ী। সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গণশুনানিতে গুম বা নিখোঁজ হওয়া অর্ধশত পরিবারের সদস্যদের বেদনাবিদ্ধ জবানিতে উঠে এসেছে ভয়াবহ এই চিত্র। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এবং গোয়েন্দারাও তৎপর, সে দেশে দিন দিন এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিটি নাগরিকই যে উৎকণ্ঠিত, তা বলা বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। অনাকাংখিত এসব ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নির্দেশক বলেও প্রতীয়মান হয়।
গণশুনানিতে নিখোঁজ পরিবারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়েই বেশিরভাগ নিখোঁজ হয়েছেন। এসব ঘটনায় মামলা না নেয়া, মামলা নেয়ায় গড়িমসি এবং কখনো মামলা নিলেও দীর্ঘদিনে তার শুনানি না হওয়ার নজির রয়েছে। সন্তান নিখোঁজের পর দীর্ঘদিন আশায় থেকে নিখোঁজ ব্যক্তির পিতা-মাতা মারা গেছেন, এমন ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। যারা ৮-১০ বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন তাদের স্বজনরাও ‘মায়ের ডাক’ গণশুনানিতে তাদের দুঃসহ দিনযাপনের কথা তুলে ধরেছেন। এতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এবং বিচারব্যবস্থার চিত্রই প্রতিফলিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সঙ্গত কারণেই এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিখোঁজ পিন্টুর বোন মুন্নির মতো সরকারের কাছে দেশের প্রতিটি নাগরিকে প্রশ্ন হতে পারে- জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘আপনাদের কি কোনো দায় নেই?’ গুম হওয়া মানুষের পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭২৭ জন। অস্বীকার করা যাবে না যে, সংশ্লিষ্টদের তৎপরতায় অনেক নিখোঁজ ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। কিন্তু দুই একজনের ফিরে আসার ঘটনা দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতির ইতিবাচক মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।
কেননা, বেশির ভাগ নিখোঁজের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনো অজানা। এখনো স্বল্প বিরতিতে দেশের কোনো না কোনো স্থানে নিখোঁজের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, চাকরিজীবীসহ এমন কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যে অপহৃত বা নিখোঁজ হননি। সংশ্লিষ্টদেরও বিষয়টি অজানা নয়। সম্প্রতি মনিকা বড়ুয়া নামে চট্টগ্রামের এক সংগীত শিক্ষিকা টিউশনি করতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। আজও তার সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ কিংবা গুম পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা নিখোঁজের ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট।
সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দেয়া বক্তব্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এই আত্মতুষ্টির যে আদৌ কোনো সামঞ্জস্য নেই, তা সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকেও স্পষ্ট হতে পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি, নিখোঁজের ঘটনায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
অন্যদিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বরাবরই তা অস্বীকার করে। এ পরিস্থিতিতে অপরাধীরাই লাভবান হচ্ছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে- এমন ভাবনাও অমূলক হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার কারণেই গুম, খুন, নিখোঁজসহ অন্যান্য অপরাধের হার বাড়ছে। অপরাধীদের এমন অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যের ভেতর দিয়ে একটি রাষ্ট্র কিছুতেই চলতে পারে না, চলতে দেয়াও উচিত নয়। আমরা মনে করি, সরকারের কার্যকর উদ্যোগই পারে দুঃসহ এই পরিস্থিতি থেকে জনগণকে মুক্ত করতে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৫:০২ ৬১৫ বার পঠিত