জাতীয় নির্বাচনের আগে যে পাঁচ মহানগরে ভোট হচ্ছে তার মধ্যে এখনও ভোটের লড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকা একমাত্র রাজশাহীতে প্রার্থীর নাম আগেই ঘোষণা হয়েছে। তিনি হলেন এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। আর লিটন ভোটের প্রস্তুতিতে পুরোপুরি ব্যস্ত।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেখানে প্রার্থিতা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে বিরোধ প্রবল, সেখানে উল্টো রাজশাহী। লিটনকে প্রার্থী মেনেই কাজ করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তারপরেও দলে কোনো পর্যায়ে যেন মান অভিমান না থাকে, সে জন্য বিশেষ উদ্যোন নিয়েছেন লিটন। কাজ করছে ১০টিরও বিশেষ কমিটি।
দলে কোনো সমন্বয়হীনতা আছে কি না, বা কাউকে নিয়ে আপত্তি আছে কি না, থাকলে কেন, কীভাবে তা মেটানো যায়, তা নিয়েই কাজ করছে এসব কমিটি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলের কোন্দল বা বিরোধ মেটানোয় এই চেষ্টাকে আদর্শও বলছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে যে পাঁচ মহানগরে ভোট হবে তার মধ্যে গাজীপুর ও খুলনায় শুরু হয়েছে প্রচার। ১৫ মে ভোটাররা জানাবেন তাদের মতামত।
আর ঈদের পর রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনায় ভোট হবে-জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর এই তিন নগরে দুই প্রধান দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এখন নিচ্ছেন নানা প্রস্তুতি। এর মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় লিটনের পক্ষে মেয়র নির্বাচনে ভোট চাওয়া হয়।
২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী শহরের চেহারা পাল্টে দিলেও পাঁচ বছর আগে সিটি নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। মেয়র হন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। কিন্তু তারপরও লিটনের বিকল্প কেউ সে মহানগরে নেই বলেই ভাবছে ক্ষমতাসীন দল।
রাজশাহী শহর সব সময় আওয়ামী লীগের দুর্বল এলাকা বলে পরিচিতি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নিজের এলাকা হলেও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই মহানগরে বারবার আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি জিতেছে। এমনকি ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয় হয় আওয়ামী লীগ।
তবে এরপর থেকে রাজশাহী আওয়ামী লীগের হাল ধরেন লিটন, আর ধীরে ধীরে দলকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জিতেন লিটন।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, কয়েক মাস আগেও সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী সদর আসনে নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন লিটন। আর লিটন সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হলে সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন চাইতেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। কিন্তু লিটনের নাম ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় ডাবলু আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর ইকবাল বলেন, ‘খায়রুজ্জামান লিটনের মতো নেতাও যেমন রাজশাহীতে নেই, তেমনি তার মতো শাসকও নেই। ফলে অন্য কেউ প্রার্থী হতে চান না।’
জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে এমনিতেই জেলা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা মাথা ঘামান না। এখনও কেউ প্রার্থী হতে চান না। সবার লক্ষ্য, শুধু লিটনকেই মেয়র নির্বাচিত করা।’
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে সিটি নির্বাচনে নাগরিক কমিটির ব্যানারে লিটনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ভোটের পর নাগরিক কমিটিতে থাকা বিশিষ্টজনদের সঙ্গে লিটনের কোনো সমন্বয় ছিল না। আর ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে সেই বিশিষ্টজনেরা আর লিটনের পক্ষে প্রকাশ্যে আগের মতো আসেননি।
আবার ভোটের এক সপ্তাহ আগে রাজশাহীতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি সাধারণ মানুষ। নির্বাচনের আগে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের হটাতে অভিযানের পর রাজশাহীতে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এর সবই যায় লিটনের বিরুদ্ধে।
নিজের পরাজয়ের প্রধান কারণ হিসেবে লিটন সব সময়ই বলে থাকেন, নির্বাচনের আগে শাপলা চত্বর নিয়ে হেফাজতে ইসলামের অপপ্রচার।
হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও এই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। তারা ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের সদস্য, যেগুলোর বেশিরভাগই বিএনপির সঙ্গে সে সময় জোটবদ্ধ ইসলামী ঐক্যজোটের অংশ ছিল।
ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কচ্যুতি হয়েছে এবং গাজীপুরে দলের নেতা ও জেলা হেফাজতের আমির ফজলুর রহমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতে সেখানে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। ফলে হেফাজতের ভোট বিএনপির বাক্সে যেমন পড়বে না, তেমনি এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ধর্ম জড়িয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারেও আর নামবেন না, এটা নিশ্চিত।
অবশ্য মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর ইকবাল বলেন, ‘পরাজয়ের কারণ ছিল নিজেদেরই। বড় দলে অনেক সময় অনেক মান-অভিমান থাকে। নির্বাচন এলে সেগুলো মাথাচাড়া দেয়। ভোটের আগে নেতাকর্মীদের সে মান ভাঙানো যায়নি। ফলে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়েছিল। আর এ কারণেই ব্যাপক উন্নয়ন করা সত্ত্বেও হেরে যান লিটন। তবে এবার নিজেদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলা হয়েছে।’
এবার ভোটের আগে নেতাকর্মীদের মান-অভিমান বা বিভেদ দূর করতে পুরো শহরে কাজ করছে ১১টি কমিটি। এক একটি কমিটির আওতায় রয়েছে আরও চারটি করে উপকমিটি। এসব উপকমিটির বিস্তার পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। উপকমিটিতে রাখা হয়েছে সর্বনিন্ম ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ১০১ জন সদস্য।
নির্বাচনের প্রস্তুতি বাস্তবায়নের কাজ করছে পুরো শহরের ওই ১১টি কমিটি। তারা উপকমিটির মাধ্যমে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে চলেছে। এই উপকমিটিগুলোতে যে শুধু আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির পদধারী নেতারাই রয়েছেন, তা নয়। আছেন এলাকার বিশিষ্টজনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে এসব কমিটি ও উপকমিটি প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মহল্লায় উঠান বৈঠকের আয়োজন করছে। তাতে উপস্থিত হয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এসব বৈঠকে নারীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। সিটি নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর থেকেই এভাবে নিজের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন লিটন।
আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, যেদিন কোথাও উঠান বৈঠক না থাকে, সেদিন পাড়া-মহল্লার বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন লিটন। নির্বাচনে জিততে তাদের কাছ থেকেই নিচ্ছেন নানা পরামর্শ। আবার নির্বাচনের দিন পোলিং এজেন্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজগুলো কোন কোন নেতাকর্মী করবেন তারও তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এদের একটি দল ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছে।
জানতে চাইলে লিটন বলেন, ‘আমার সময়ে রাজশাহীর যে উন্নয়ন হয়েছে, তা এখনো মানুষ মনে রেখেছে। এই উন্নয়ন এখন থমকে গেছে। এখন জনগণ সেটা উপলব্ধি করছে। ফলে আবারও উন্নয়নের জন্যই জনগণ আমাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চাইছেন। এবার রাজশাহী নগরবাসী আর কোনো ভুল করতে চাইবে না।’
রাজশাহী মহানগরে নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৬ জুন। ২১ জুলাই শপথ নেন মেয়র বুলবুল। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাসের মধ্যে ফের ভোট গ্রহণের বাধ্যবোধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, চলতি মাসের ২১ তারিখের পর যেকোনো সময় হতে পারে নির্বাচন। তবে সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা রাজশাহীতে এসেই জানিয়েছেন, ভোট হবে জুলাইয়ে।
রাজশাহী মহানগরে ভোট ঘিরে বিএনপিতে প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিবেদন থাকছে আগামীকাল
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫৩:৫২ ৫৭৪ বার পঠিত