গৌতম আদানির সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কী আছে

প্রথম পাতা » অন্যান্য সংবাদ » গৌতম আদানির সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কী আছে
মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩



গৌতম আদানির সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কী আছে

এ প্রথমবার বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন না গৌতম আদানি। এর আগেও একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছেন বিপদের। ১৯৯৮ সালে অপহৃত হয়েও বেঁচে ফেরেন। ২০০৮ সালে হোটেল তাজমহলে সন্ত্রাসী হামলার সময় বেজমেন্টে বন্দিজীবন কাটিয়ে বেঁচে ফিরেছেন এবং সামলে নিয়েছেন। তবে এবারেরটার প্রকৃতি আলাদা। ব্যক্তি আদানি নয়; এবার আঘাত লেগেছে তার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদ হারিয়েছেন গৌতম আদানি। তাই এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, গৌতম আদানির সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কী আছে?

২০২৩ সালের শুরুতে চমক দেখানো শুরু করে গৌতম আদানির ব্যক্তিগত ভাগ্য। তবে সেই চমক তার অধঃপতনের ইঙ্গিত ছিল কি না, তা নিয়েও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বছরের শুরুতে আদানি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিয়েছিল তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। তারপরও প্রশ্ন উঠছে যে, আদানির অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য টিকবে তো?

আদানি গ্রুপের পতনের শুরু হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নামে নিউইয়র্কভিত্তিক এক বিনিয়োগ ফার্মের প্রতিবেদনের হাত ধরে। ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি গ্রুপ পুঁজিবাজারে স্টক ম্যানিপুলেশন এবং তহবিল নয়ছয় করেছে। এমনটা করার উদ্দেশ্য ছিল–আদানি গ্রুপের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারমূল্য বাড়িয়ে তহবিল বাড়িয়ে নেয়া। জবাবে, আদানি গ্রুপও ৪১৩ পৃষ্ঠার এক তথ্য বিবরণী এবং প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করে হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনকে ‘পুরোপুরি ভুয়া’ এবং ভারতের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ বলে অভিহিত করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

শেষটা না হলেও কিছুটাতো হয়েছে। হুহু করে শেয়ারের দাম কমতে থাকার মুখে আদানি গ্রুপ সরাসরি সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বিক্রি শুরু করে। তাতেও সুরক্ষা হচ্ছিল না। খুচরা বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। তারপরও আদানি গ্রুপ বেশকিছু বড় ক্রেতা পেয়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের বেশ কয়েকটি বিমা কোম্পানি এবং দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি ব্যাংক, আমিরাতের বেশ কয়েকটি ফার্ম এবং আরও কয়েকটি ভারতীয় ব্যবসায়ী পরিবার আদানির পাশে দাঁড়ায় এবং ৪০ কোটি ডলার ফান্ড ম্যানেজ করতে সহায়তা করে।

ফেব্রুয়ারি মাসের পহেলা দিনেই ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইস ক্রেটিড ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আমানত হিসেবে আদানি গ্রুপের বন্ড গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিনই আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দর পড়ে যায় ৩০ শতাংশ। এরপর আদানি গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দরও পড়তে থাকে। ফলে মাত্র এক দিন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে আদানি গ্রুপের প্রাণ বাঁচানোর যে প্রবণতা দেখাচ্ছিল বন্ডগুলো, সেগুলোর দামও পড়তে থাকে। দাম আরও পড়ে যাওয়া রুখতে আদানি গ্রুপ সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দেয়।

আদানি গ্রুপের ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এখনও অজানা। তবে এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের কর্মকর্তারা বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় নিতে কাজ শুরু করেছেন। কাজে লাগানো হয়েছে বিশেষ গবেষক দলকে। বিশেষ এ দলটি আদানি গ্রুপের হয়ে প্রথমে কোভিড-১৯-এর ধাক্কা মোকাবিলায় কাজ করেছে; পরে কাজ করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা কাটাতে। তারা বলছে, তাদের পরিকল্পনা বাস্তাবিয়ত হতে আরও দু-তিন বছর লেগে যাবে। আদানিও বিনিয়োগকারীদের চাঙা করতে বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন পর্যাপ্ত অর্থপ্রবাহ রয়েছে। আমাদের মূলধন এখন নিরাপদ। অতীতে ঋণ পরিশোধের ইতিবাচক রেকর্ড রয়েছে আমাদের।’

আদানির অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের সামনে যে হুমকি, তা এখনও হয়তো তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি নয়। এখনও আদানির হাতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। এ সবের মধ্যে রয়েছে, ভারতের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরের মালিকানা। এর বাইরে শ্রীলঙ্কা, ইসরাইল ও অস্ট্রেলিয়ায়ও আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন বন্দর রয়েছে। এখনও আদানি গ্রুপের হাতে রয়েছে ভারতের মোট গুদামজাত খাদ্যের ৩০ শতাংশের মজুত, রয়েছে ভারতের মোট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের এক-পঞ্চমাংশের মালিকানা। ভারতের এক-পঞ্চাংশ ফ্লাইটও নিয়ন্ত্রণ করে আদানি গ্রুপ এবং সম্ভবত আদানি গ্রুপ ভারতের মোট সিমেন্ট উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ একা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া আদানি গ্রুপ ভারতের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হতে চায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে মিলে। গত অর্থবছর আদানি গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মোট আয় ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ এবং গত বছর আদানি গ্রুপের নিট মুনাফা ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলার।

আদানি তার সাম্রাজ্য টিকে যাওয়ার ব্যাপারে এখনও তীব্র আশাবাদী। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, খুচরা বাজারে শেয়ার বিক্রি বাতিল করার সিদ্ধান্ত তার গ্রুপের বিদ্যমান কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো রেটিং এজেন্সি এখনও আমাদের ঋণ পুনর্মূল্যায়ন করেনি। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগের ফলে এখনও বিশ্বব্যাপী স্টকমার্কেট সূচকগুলো থেকে আদানিকে বাদ দেয়নি।’

তবে আদানি যা-ই বলেন না কেন, তার গ্রুপের বিপর্যয় ভারতে বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ, ২০২৩ সাল থেকে শুরু করে ২০২৭ সাল নাগাদ ভারতে বিভিন্ন প্রকল্পে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা ছিল আদানি গ্রুপের। এর মধ্যে রয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মুম্বাইয়ে একটি বিমানবন্দর, ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দক্ষিণ কোরীয় জায়ান্ট পোসকোর সঙ্গে স্টিল কারখানা তৈরিসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্প। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতকে ক্লিন এনার্জি পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রকল্প তাতে হাইড্রোজেন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস খাতে বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে আদানির। এসব কাজে দরকার ব্যাপক বিনিয়োগের। ধারণা করা হচ্ছিল, আদানি গ্রুপের শেয়ারের উচ্চমূল্য থেকে এসব নতুন অর্থ সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও যদি গৌতম আদানির গ্রুপের বন্ডের দাম বাড়তে থাকে এবং শেয়ারের দাম কমে কিংবা অপরিবর্তিত থাকে, তবে এ পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া আদানি গ্রুপের দুরবস্থার প্রভাব ভারতের বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন, যেসব জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান আদানির শেয়ার কিনেছে, তারা বিপদে পড়তে পারে।

আদানি গ্রুপের আরেকটি বিপদ হলো–বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো সুযোগ আদানিকে দিচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ ধরেই বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে ভারতীয় পুঁজি মন্দাভাব দেখিয়েছে। দুদিনে মূল্য হারানোর কারণে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের পুঁজিবাজার থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা আদানি গ্রুপে তো বটেই, ভারতেও বিনিয়োগ করতে দুবার ভাবছে।

এত কিছুর মধ্যেও আদানি তার ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন আদানি গ্রুপের শেয়ার ক্রমেই চলে যাচ্ছে, তখন গৌতম আদানি ইসরাইল সফর করছেন। নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছেন হাইফা বন্দরের। সেখানেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা আমাদের দৃষ্টিসীমা বদলে দেব।’ আদানি কতটা সফল হবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বদলে দেয়ার পথ যে মোটেও মসৃণ হবে না, তা বোধহয় না বলে দিলেও চলে।
(দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৩:৩৭   ১৮১ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

অন্যান্য সংবাদ’র আরও খবর


বেদনায় ভরা দিন
বছরের প্রথম চন্দ্রগ্রহণ আগামী শুক্রবার
‘আগামী দশকে আরেকটি মহামারি আসতে পারে’
গৌতম আদানির সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কী আছে

News 2 Narayanganj News Archive

আর্কাইভ