নির্ধারিত থাকলেও বিক্রেতাদের হাত বদল হতেই বেড়ে যাচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের দাম। ১২ কেজির সিলিন্ডারে ক্রেতাকে দিতে হচ্ছে অন্তত দেড়শো টাকা অতিরিক্ত, যা চাপ সৃষ্টি করছে ভোক্তাদের উপর। ক্রেতা ঠকানোর এই দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) নিতে হবে বলে দাবি করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা সংগঠন ক্যাব। তবে বিইআরসি জানাচ্ছে, দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর হলে সিলিন্ডার উধাও হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ দিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক।
রান্না চুলায় বসিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও সরতে চান না কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা শাহীদা আক্তার। কেননা সেপ্টেম্বর মাসের জন্য নির্ধারিত ১ হাজার ২৭০ টাকা মূল্যের ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। তিনি বলেন, একেক দোকানে একেক ধরনের দাম রাখা হচ্ছে এবং সরকার নির্ধারিত দাম মানার কোনো চেষ্টা ডিলাররা করছেন না।
এদিকে, ১২ কেজির সিলিন্ডার কিনতে রাজধানীর বাংলামোটরের রুটি ব্যবসায়ী তোতা মিয়াকে গুনতে হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। তিনি বলেন, প্রতি সিলিন্ডারের জন্য গুণতে হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। যা অনেক বেশি।
সিলিন্ডারের দাম কেন সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি হচ্ছে, সেই বিষয়ে ডিলাররা জানান, সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে দূরত্ব ভেদে অতিরিক্ত খরচ নেয়া হয়। ডিলার মেহেদি হাসান বলেন, ‘সরকার দোকান থেকে কেনার দাম নির্ধারণ করেছে, কিন্তু বাসায় পৌঁছে দেয়ার সময় খরচ হওয়ায় কিছুটা দাম বাড়ে।’
নির্ধারিত মূল্যের সঙ্গে আধা কিলোমিটার দূরত্বে পরিবহন খরচ বাবদ বাড়তি ৫০ টাকা নেয়ার পক্ষে যুক্তি দিলেও এর বেশি অর্থ আদায়কে অনেক খুচরা বিক্রেতা প্রতারণা হিসেবে দেখছেন। ডিলার জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে, তাই চাইলেও বাড়তি দাম নেয়ার সুযোগ নেই।’
ভোক্তারা অভিযোগ করছেন, প্রতি সিলিন্ডারে ১০০-২০০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। মনিটরিংয়ের অভাবের কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন।
গ্রাহক ঠকিয়ে গ্যাস বিক্রির এই বিপণন কাঠামো গড়ে ওঠার দায় এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে নিতে হবে বলে যুক্তি ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের। সংগঠনটির জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘ভোক্তা অধিদফতর মনে করছে এটি দেখবে বিইআরসি, কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে বিইআরসি পর্যাপ্ত নজর রাখছে না। এই সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।’
বিইআরসি বলছে, দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর হলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হতে পারে। চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ জানান, ‘বোতলের চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে; এ অবস্থায় কিছু করার নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিচালনায় থাকায় সারাদেশে এর সংখ্যা কমে গেছে। আদেশ কার্যকর করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় ভোক্তা অধিকার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম নিশ্চিত করা কঠিন। পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না দিতে পারলে বাজার থেকে সিলিন্ডার স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয়ে যাবে।’
দামবৃদ্ধির এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পেতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করার পরামর্শ সংস্থাটির সাবেক মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের। তিনি বলেন, ‘ভোক্তা আইনে অভিযোগ করলে শুনানি করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।’
এদিকে, ক্রেতার কাছ থেকে নেয়া বাড়তি টাকা ক্যাশ মেমোতে না লেখার অভিযোগ খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে সিলিন্ডার কেনার ফলে গ্রাহকদের মাসিক খরচের হিসাব ভারী হচ্ছে। এই হরিলুটের বাজারে সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চুপ, আর এই পরিস্থিতির সমাধি কবে হবে; সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অনিশ্চিত।
বাংলাদেশ সময়: ১০:২৮:২১ ২৫ বার পঠিত