![]()
জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। এরই মধ্যে নতুন মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে যা আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হবে এবং নতুন মহাসচিব ২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
জাতিসংঘের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদ ও ১৯৩ সদস্য বিশিষ্ট সাধারণ পরিষদের সভাপতি যৌথভাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রার্থী মনোনয়ন আহ্বান করে চিঠি পাঠানোর মধ্যদিয়ে মহাসচিব নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নতুন মহাসচিব নির্বাচনের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের সভাপতিদ্বয় একটি যৌথ চিঠি ইস্যু করেছেন, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রার্থীদের মনোনয়নের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রথা অনুযায়ী, মহাসচিবের পদটি অঞ্চলগুলোর মধ্যে ক্রমান্বয়ে আবর্তিত হয়। ২০১৬ সালে যখন গুতেরেস (পর্তুগাল) নির্বাচিত হন, তখন আসলে পূর্ব ইউরোপের পালা ছিল। এবার মহাসচিব নির্বাচনে লাতিন আমেরিকাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। যদিও অন্যান্য অঞ্চল থেকেও প্রার্থী আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবার মহাসচিব নির্বাচনে প্রার্থী কারা?
মিশেল ব্যাশেলে- চিলি
চিলি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাশেলেকে মনোনয়ন দেবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিক। ব্যাশেলে ছিলেন চিলির প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং দুবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া তিনি ২০১৮-২০২২ মেয়াদে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার এবং ২০১০-২০১৩ মেয়াদে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থার (ইউএন উইমেন) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
রেবেকা গ্রিনস্প্যান- কোস্টারিকা
চলতি বছরের অক্টোবরে কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো চাভেস জানান, দেশটি তাদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রেবেকা গ্রিনস্প্যানকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবে। রেবেকা গ্রিনস্পান বর্তমানে জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন (ইউএসিটিএড)-এর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাফায়েল গ্রোসি-আর্জেন্টিনা
রাফায়েল গ্রোসি বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর রয়টার্সের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যা, আমি প্রার্থী হচ্ছি।’ আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞ কূটনীতিক গ্রোসি ২০১৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও যারা আলোচনায়
এছাড়া মহাসচিব পদে ‘রিউমারড পটেনশিয়াল ক্যান্ডিডেটস’ হিসেবে আরো কয়েকটি নাম আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন মেক্সিকোর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলিসিয়া বার্সেনা। তিনি বর্তমানে দেশটির পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী।
জাতিসংঘে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বার্সেনার। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক কমিশনের (ইসিএলএসি) নির্বাহী সচিব হিসেবে। টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ কূটনীতিতে তার অবদান তাকে লাতিন ব্লকের শক্ত প্রার্থী করেছে।
আলিসিয়া বার্সেনা ছাড়াও এ ‘সম্ভাব্য’ তালিকায় রয়েছেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। আছেন বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আদিবাসী রাজনীতির শক্তিশালী মুখ গ্লোবাল সাউথের ‘অন্য কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বিবেচিত ডাভিড চোকেউয়াঙ্কা এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চতুর্থ নারী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মারিয়া ফার্নান্দা এস্পিনোসা গারসেস।
আরও আছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বুলগেরিয়ার ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। আছেন ২০১৬ সালের নির্বাচনে গুতেরেসের প্রতিদ্বন্দ্বী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি ও সার্বিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক ইয়েরেমিচ।
জাতিসংঘের বর্তমান ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল নাইজেরিয়ার আমিনা মোহামেদ নামটিও আলোচনায় রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে তার নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। আফ্রিকান ইউনিয়নের একাধিক দেশ তাকে মনোনয়নের কথা ভাবছে। আরো আছেন জলবায়ু ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মুখ হিসেবে বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি।
মহাসচিব নির্বাচন কীভাবে হবে?
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জাতিসংঘের ১০ম মহাসচিব হিসেবে নির্বাচনের জন্য ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন প্রার্থীর নাম সুপারিশ করবে।
এরপর নিরাপত্তা পরিষদ ‘স্ট্র পোল’ নামে গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণ পরিচালনা করবে যতক্ষণ না একজন প্রার্থীর বিষয়ে ঐকমত্য হয়। স্ট্র পোলে প্রতিটি প্রার্থীর জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো ‘সমর্থন’, ‘অসম্মতি’ বা ‘মত নেই’ মর্মে ভোট দিতে পারবে।
তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচ রাষ্ট্র- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে অবশ্যই একমত হতে হবে। ভেটো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য স্ট্র পোলের ব্যালট ঐতিহ্যগতভাবে ১০ জন নির্বাচিত সদস্যের থেকে ভিন্ন রঙের হয়।
২০১৬ সালে যখন গুতেরেসকে সাধারণ পরিষদে সুপারিশের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, তখন নিরাপত্তা পরিষদের একমত হতে ছয়টি স্ট্র পোল লেগেছিল। এরপর নিরাপত্তা পরিষদ ঐতিহ্যগতভাবে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মধ্যদিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি পাস হতে পাঁচ ভেটো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসহ নয়টি ভোটের প্রয়োজন হয়।
এরপর সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটির সুপারিশ করা হয়। মহাসচিব নিয়োগের জন্য সাধারণ পরিষদের অনুমোদন দীর্ঘদিন ধরেই ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ?
ঐতিহাসিকভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচন একটা ‘অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া’র মধ্যদিয়ে হয়ে আসছে। তবে এটা ‘স্বচ্ছ’ করতে কাজ করছে জাতিসংঘ। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, প্রত্যেক প্রার্থীকে মনোনয়নের সময় তাদের একটা ‘ভিশন স্টেটমেন্ট’ বা কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে।
ওই ভিশন স্টেটমেন্টটি জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রচার করতে হবে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়। সাধারণ পরিষদ আরও বলেছে, প্রতিটি প্রার্থীকে তাদের তহবিলের উৎস প্রকাশ করতে হবে এবং যেসব প্রার্থী ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের কোনো পদে আছেন, তাদেরকে নির্বাচনের সময় নিজেদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হবে, যাতে স্বার্থের সংঘাত না ঘটে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের কাজ কী?
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী মহাসচিব হলেন সংস্থার ‘প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা’। তিনি একাধারে কূটনীতিক, সচিব ও নির্বাহী প্রধান। বর্তমানে গুতেরেস ৩০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক কর্মী এবং প্রায় ৬০ হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনী তত্ত্বাবধান করেন। সংস্থার বার্ষিক মূল বাজেট ৩.৭ বিলিয়ন ডলার, আর শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের বাজেট ৫.৬ বিলিয়ন ডলার।
কোনো নারী কি জাতিসংঘের মহাসচিব হয়েছেন?
জাতিসংঘের ৮০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী মহাসচিব হননি। সম্প্রতি সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোনো নারী এখনো মহাসচিব পদে আসেননি,’ এবং সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা নারীদের প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫১:৩২ ৪ বার পঠিত