![]()
২০২৫ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও হত্যার ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে সরাসরি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ সেল বাংলাদেশের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত এক বছরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ৩৮৮ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয়—উভয় পক্ষের এই নিপীড়ন দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে চরমভাবে সংকুচিত করেছে।
সেলের পরিসংখ্যানে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র:
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে তিনজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গাজীপুরে—দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন নিহত হন। এছাড়া আরও চারজন সাংবাদিকের মরদেহ রহস্যজনকভাবে উদ্ধার করা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে ১২২ জন সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন এবং ১২৫ জন প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন।
প্রকাশিত সংবাদের জেরে অন্তত ২৩৫ জন সাংবাদিক মামলার মুখোমুখি হয়েছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বোচ্চ নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায় ৯৯ জন। এরপর গাজীপুরে ১৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৫ জন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৩৮ জন, রংপুরে ২১ জন এবং বরিশালে ১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইনি নিপীড়ন ও সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার:
প্রতিবেদনে চলতি বছরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’ ব্যবহারের একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আলমগীরের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টকশোতে সরকারের সমালোচনা করার পর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তাকে আটক করে এবং ‘আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা’ চালানোর অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
একইভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদকে সেপ্টেম্বর মাসের একটি নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা অনেকের মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তারে এ বছর ‘মব কালচার’ বা দলবদ্ধ চাপের অপপ্রয়োগও দেখা গেছে। গত ২৮ এপ্রিল সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করাকে কেন্দ্র করে তিন টেলিভিশন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক প্রচার চালানো হয়।
এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ৩২টি ফৌজদারি মামলায় অন্তত ১৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা একাধিক মামলায় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে।
সেলের মনিটরিং পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ:
সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ সেল বাংলাদেশের সহকারী পরিচালক (আইন) মোহাম্মদ আলী আবির বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে মব ভায়োলেন্স বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। ২০২৪ সাল থেকে সাংবাদিক নির্যাতনের সংখ্যা ও ধরন নজিরবিহীনভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এই সংকট নিরসনে সাংবাদিক নির্যাতনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারি কমিটি গঠিত হলেও আইনি নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। এটি এখন একটি কাঠামোগত নিপীড়নের রূপ নিয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক শাসনের জন্য সরাসরি হুমকি। দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে ভিন্নমতের প্রতি রাষ্ট্রের সহনশীলতা এবং সাংবাদিকদের কার্যকর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও হত্যার ঘটনাগুলো স্থানীয় সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর নজরেও এসেছে। সেলের মনিটরিং প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন।
সেলের মনিটরিং প্রতিবেদনের প্রধান বিষয়:
‘বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সেল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত ১৭ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আলোচিত ঘটনা হিসেবে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বর্তমানে কুড়িগ্রাম কারাগারে রয়েছেন।
অতীত সহিংসতা ও বিচারহীনতা:
সেলের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের ১ আগস্ট ‘মনসুন বিপ্লবের এক বছর পর: ছয়জন নিহত সাংবাদিকের ন্যায়বিচার এখনও দূর’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিহত সাংবাদিকদের বিচার না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে অন্তত একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং পাঁচজন সাংবাদিক বর্তমানে আটক বা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছেন। এটি আগের বছরের সহিংসতা ও বিচারহীনতার ধারাবাহিক ফল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মনিটরিং প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ছয়জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন—শাকিল হোসেন, মেহেদি হাসান, আবু তাহের মোহাম্মদ তুরাব, তাহির জামান প্রিয়ো, প্রদীপ কুমার ভৌমিক ও সোহেল আখঞ্জি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ গুলিতে এবং একজন গণপিটুনিতে নিহত হন। এক বছর পার হলেও এসব হত্যাকাণ্ডের কার্যকর বিচার হয়নি।
সেলের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ছিল ২৮৮টি, যা নির্বাচনের বছর ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০২টিতে। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় তা রেকর্ড ৫৫৫টিতে পৌঁছায়। ২০২৫ সালে ঘটনাসংখ্যা কমে ৩৭৭ হলেও নির্যাতনের ধরন আরও ভয়াবহ হয়েছে। মোহাম্মদ আলী আবির বলেন, “এখন শুধু ব্যক্তি সাংবাদিক নন, সরাসরি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত হচ্ছে—যা নজিরবিহীন।”
সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ সেল বাংলাদেশের প্রধান মো. খায়রুল আলম রফিক বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি এক ভয়াবহ স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। হামলা, হুমকি ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে সত্য প্রকাশকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে। এই সংকটের মূল কারণ দণ্ডহীনতার সংস্কৃতি—কারণ অপরাধীরা জানে, সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েও তারা পার পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:২৫:১২ ১৫ বার পঠিত