চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আর নেই (ইন্নলিল্লাহি…রাজিউন)।
বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৪টার দিকে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছিলেন।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রয়াত এই নেতার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা।
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মহিউদ্দিনের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এই আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
ওবায়দুল কাদেরের শোক:
মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
শুক্রবার সকালে এক শোকবার্তায় মন্ত্রী মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
গত ১১ নভেম্বর রাতে কিডনিজনিত সমস্যায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে পরদিন তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেয়া হয়। সেখানে স্কয়ার হাসাপাতলে তিনদিন চিকিৎসা শেষে, গত ১৬ নভেম্বর তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে ১১ দিন চিকিৎসা শেষে গত ২৬ নভেম্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ফের ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিছুটা সুস্থবোধ করায় গত ১২ ডিসেম্বর তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এরপর আবারও অসুস্থবোধ করলে বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
মহিউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে। বাবা রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগম।
ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিন ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে।
১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে।
উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন।
সম্মুখ সমরের যোদ্ধা মহিউদ্দিন স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পান।
পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’।
সে সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করে গেছেন এই রাজনীতিবিদ।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক অর্জন থাকলেও কখনও সংসদ সদস্য হতে পারেননি মহিউদ্দিন। ১৯৮৬ সালে রাউজান থেকে এবং ১৯৯১ সালে নগরীর কোতোয়ালি আসনে ভোট করে তিনি হেরে যান।
তবে ১৯৯৪ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েই মহিউদ্দিন বিজয়ী হন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০০৫ সালে তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
তার মেয়াদে পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ‘অনন্য দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। বন্দর নগরীর ষোলশহর এলাকায় তার বাসার গলিটি চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘মেয়র গলি’ হিসেবেই পরিচিত।
প্রায় দুই যুগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
তার বড় ছেলে মুহিবুল হাসান নওফেলকে গতবছর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করে নেওয়া হয়। ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন করেন ব্যবসা।
মহিউদ্দিনের ছয় ছেলে মেয়ের মধ্যে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্যান্সারে মারা যান। বাকি তিন মেয়ের মধ্যে জেবুন্নেসা চৌধুরী লিজা গৃহিনী। যমজ বোন নুসরাত শারমিন পিয়া ও ইসরাত শারমিন পাপিয়া মালয়েশিয়া থেকে এমবিএ করেছেন।
বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সারাদেশে পরিচিতি পেলেও মহিউদ্দিন সব সময় নিজেকে চট্টগ্রামের রাজনীতির গণ্ডিতেই ধরে রেখেছেন।
গতবছর ডিসেম্বরে জন্মদিনে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাবে তিনি বলেন, “টিল ডেথ, আই উইল ডু ফর দ্য পিপল অব চিটাগং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি।”
বাংলাদেশ সময়: ১৮:০৫:৫৯ ৩৯৩ বার পঠিত