দেশবরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চট্রলবীর প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা চট্রগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আর নেই। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর।
সম্প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরী বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আসলে প্রথমে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুইদিন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পর তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে ম্যাক্স হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন আমার বাবা। ঢাকায় একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই নিয়ে আসা হয়েছিলো।’
এদিকে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। দলীয় নেতা-কর্মীসহ হাজার হাজার মানুষ গভীর রাতেই হাসপাতাল ও তার বাসভবনে ভিড় জমান। নেতা-কর্মীদের মাঝে কান্নার রোল ওঠে। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সাবেক নগর পিতাকে দেখতে রাতেই ছুটে যান হাসপাতালে। ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাতেই শুরু হয় শোক প্রকাশ। সকালে মহিউদ্দিনের মরদেহ নগরীর ষোলশহর এলাকায় তার চশমা হিলের বাসায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও নেতা-কর্মীরা ভিড় করেন শেষবারের মতো তাকে দেখতে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মরহুম মহিউদ্দির চৌধুরীর ষোল শহর এলাকার চশমা হিলের বাসভবনে যান এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজ বাসায় মৃদু হার্ট অ্যাটাক হলে গত ১১ নভেম্বর ম্যাক্স হাসপাতালে নেয়া হয়। পরদিন হেলিকপ্টারে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়।
সিঙ্গাপুরের অ্যাপোলো গ্লিনিগ্যালস হসপিটালে মহিউদ্দিনের এনজিওগ্রাম এবং হার্টের দুটি ব্লকে রিঙ বসানো হয়। ১১ দিনের চিকিৎসা শেষে ২৬ নভেম্বর রাতে মহিউদ্দিনকে দেশে এনে আবারও স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ১২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়।
এই অবিসংবাদিত নেতা তিন মেয়াদে দীর্ঘ ১৬ বছর চট্টগ্রামের নগর পিতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো মেয়র পদে জয়ী হন। ২০০৫ সালে তিনি ক্ষমতাসীন বিএনপির একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন।
তার মেয়াদে পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। চট্টগ্রামের স্বার্থবিষয়ক যে কোন বিষয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর উচ্চকণ্ঠ সর্বজনবিদিত। এ কারণে তিনি ‘চট্টলবীর’ নামে খ্যাত। রাজনীতি ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের কারণে তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।
এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ।
মহিউদ্দীন চৌধুরী ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচ,এস,সি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। বুদ্ধিমত্তার সাথে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদও তিনি অলংকৃত করেন।
প্রায় দুই যুগ চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন সভাপতি হন মহিউদ্দিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আজ বাদ আসর ্ঐতিহাসিক লাল দিঘীর ময়দানে মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরী নামাজে জানাজা অনুষ্টিত হয়।
জানাজায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সমবপাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিন, ড. হাসান মাহমুদ, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ,ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী,জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম, এ, সালাম,সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস চালাম,চট্রগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন,বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান,আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জাফরুল ইসলাম চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীও সর্বস্তরের জনতা শরিক হন।
মরহুমের পারিবারিক সুত্র জানিয়েছে, মরহুমের লাশ ষোলশহর এলাকার চশমা হিলের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৫:৫০ ৪৪০ বার পঠিত