![]()
২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ন্যায্য রূপান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে ১২ দফা নাগরিক ইশতেহার প্রকাশ করেছে দেশের নাগরিক সমাজ। মঙ্গলবার রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডাব্লিউজিইডি)’ এই ইশতেহার উন্মোচন করে। সহযোগী সংগঠন হিসেবে অংশ নেয় বেলা, বিলস, ক্লিন, ইটিআই বাংলাদেশ, লিড বাংলাদেশ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও রিগ্লোবাল।
নাগরিক সমাজের দাবি— নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো এমন অঙ্গীকার দিক, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমে, শক্তির সার্বভৌমত্ব দৃঢ় হয় এবং পরিবেশসহনশীল, জনগণ-কেন্দ্রিক জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিত হয়। আয়োজকদের মতে অপচয়, অস্বচ্ছ চুক্তি, দুর্বল পরিকল্পনা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর নীতির কারণে বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে, যা মানুষের ওপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ইশতেহার পাঠ করেন ক্লিন-এর নেটওয়ার্ক এডভাইজার মনোয়ার মোস্তফা। তিনি বলেন, দেশে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে ৯৯ দশমিক ২৫ শতাংশ পরিবার, কিন্তু এই অগ্রগতির আড়ালে রয়েছে আর্থিক অস্থিতি, পরিবেশগত ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি। তার ভাষায়, ‘২০০৮ সালে বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ ছিল ১৪৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২৮১ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন। দূষণের কারণে দেশের বায়ুমান বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।’
বিডাব্লিউজিইডি-এর সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক গড়মিলের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘গত ১৬ বছরে বেসরকারি কোম্পানিগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ নিয়েছে ১ দশমিক ৭২ ট্রিলিয়ন টাকা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন টাকা, আর সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২ দশমিক ৩৬ ট্রিলিয়ন টাকা।’ তার মতে, সাধারণ মানুষের অর্থ জীবাশ্ম জ্বালানিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে।
প্যানেলে আরও বক্তব্য দেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ওয়াসিউর রহমান এবং লিড বাংলাদেশের আইনজীবী ও গবেষণা পরিচালক শিমনউজ্জামান। তারা বলেন, দেশের জন্য ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক শক্তি রূপান্তর এখন সময়ের দাবি।
১২ দফা নাগরিক ইশতেহার-
১. জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন: জলবায়ু ঝুঁকি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন নীতি করতে হবে। নীতি প্রণয়নের আগে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে।
২. পিপিএ ও বাস্তবায়ন চুক্তি উন্মুক্তকরণ: দুর্নীতি প্রতিরোধে সব বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি ও বাস্তবায়ন চুক্তি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় প্রকাশ করতে হবে; পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি কমানো: শিল্প, ব্যবসা ও আবাসিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে বাধ্যতামূলক করতে হবে; কর রেয়াত ও সহজ ঋণ দিতে হবে।
৪. নতুন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ: নতুন কয়লা, তেল ও গ্যাসভিত্তিক প্রকল্পের অনুমোদন বন্ধ এবং অকার্যকর কেন্দ্রগুলো নবায়নযোগ্য স্থাপনায় প্রতিস্থাপন করতে হবে। অকার্যকর কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করতে হবে।
৫. নতুন এলএনজি টার্মিনালে না: পুরোনো গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র বন্ধ করে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো এবং শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে। সব খাতে বাধ্যতামূলক মিটারিং চালু করতে হবে।
৬. নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ: ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশ ও ২০৫০ সালে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে; জাতীয় বাজেটে অন্তত ৪০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে।
৭. পরিবহণ খাত সবুজায়ন: বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর শুল্ক ও কর কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ কমানো এবং ব্যাটারি আমদানি কর শূন্যে নামাতে হবে।
৮. জাতীয় গ্রিড আধুনিকায়ন: স্মার্ট গ্রিডে রূপান্তরের বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ‘সূর্যবাড়ি’ কর্মসূচিতে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি, ৭০ শতাংশ সহজ ঋণ; নারী, কৃষক, শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রে আরও ১০ শতাংশ বাড়তি সহায়তা।
৯. ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান: নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে নারী, তরুণ, শ্রমজীবী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণসুবিধা।
১০. অব্যয়বহুল প্রযুক্তিতে নির্ভরতা না: অ্যামোনিয়া, সিসিএস, তরল হাইড্রোজেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুতের মতো ব্যয়বহুল ও অপ্রমাণিত প্রযুক্তি বাদ দিয়ে বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহার ও জৈব সারের মাধ্যমে সার্কুলার সবুজ অর্থনীতি চালু করা।
১১. অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি: নারী, আদিবাসী, কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী ও দরিদ্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে মুনাফার অংশ প্রদান।
১২. কৃষিজমি সুরক্ষা: বিদ্যুৎ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ; দীর্ঘমেয়াদি ইজারা পদ্ধতি চালু এবং ‘অ্যাগ্রিভোলটাইকস’ ও ‘ফ্লোটোভোলটাইকস’ প্রকল্পে বিশেষ প্রণোদনা।
নাগরিকপক্ষ আশা প্রকাশ করেছে, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো এই ১২ দফা দাবি নিজেদের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং জ্বালানি খাতকে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও ন্যায্য রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫২:৫৯ ১৬ বার পঠিত