
উষা দাস বলেন, ‘আমাগের এলাকায় কোনো কাজই নাই, স্বামী পরের ক্ষেতে কাজ করে কোনোদিন ৩০০ টাকা পায়, কোনাদিন তাও হয় না। দূরে গিয়ে কাজ কোথায় করবে? এই শাকপাতাই আমাদের নিত্য খাবার। মাসের মধ্যে একদিনও ভালো খাবার জোটে না আমাদের।’
সকালবেলা পাশের ক্ষেত থেকে কচুশাক তুলে আনছিলেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কচুবুনিয়া গ্রামের গৃহবধূ উষা দাস। দুপুরের খাবারে সেদিন ছিল শুধু কচুশাক আর ডাল। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এরকম চলে তাদের পরিবারে—মাছ বা ডিমের দেখা পাওয়া স্বপ্নের মতো। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দিনমজুর,।
এমন দরিদ্রতা আর অসহায়ত্বের গল্প খুলনা অঞ্চলের বহু পরিবারে। খুলনা বিভাগের গড় দারিদ্র্যের হার দেশের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বিভাগটির অন্তত ১৮টি উপজেলা রয়েছে উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচে। খুলনা বিভাগের বহু উপজেলা রয়েছে উচ্চ দারিদ্র্যের শীর্ষে—যেখানে প্রায় প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। এসব উপজেলায় মানুষের আয় এত কম যে ন্যূনতম খাবার ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এবং বিশ্বব্যাংকের (WB) যৌথভাবে পরিচালিত ‘পভার্টি ম্যাপ অব বাংলাদেশ ২০২২’ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার বিভিন্ন এলাকায় দারিদ্র্যের হার ২১ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা সবচেয়ে বিপর্যস্ত, যেখানে দারিদ্র্যের হার ৩৩.৪ শতাংশ। সম্প্রতি এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
উপজেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, যশোরের কেশবপুর উপজেলায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি ৩৩.৪ শতাংশ। যা খুবই উচ্চ দারিদ্রতা হিসেবে চিন্হিত। ১৮টি উপজেলা উচ্চ দারিদ্র হিসেবে চিন্হিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলাগুলো হলো, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা ২৭.৭ শতাংশ, যশোরের অভয়নগর উপজেলা ২৭.২ শতাংশ, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা ২৬.৪ শতাংশ, কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলা ২৬.৬ শতাংশ, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা ২৬.০ শতাংশ, সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলা ২৫.৪ শতাংশ, মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলা ২৪.৮শতাংশ, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলা ২৪.৮ শতাংশ, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা ২৪.৬ শতাংশ, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা ২৪.৩ শতাংশ, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা ২৩.৭ শতাংশ, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা ২২.৪ শতাংশ, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা ২২.৮ শতাংশ, চুয়াডাঙ্গার দামুরহুদা উপজেলা ২১.২ শতাংশ, ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলা ২১.৯ শতাংশ, ঝিনাইদহ’র সদর উপজেলা ২১.৭ শতাংশ এবং কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা ২১.৬ শতাংশ।
এ জরিপের পদ্ধতি ও তাৎপর্য সম্পর্কে খুলনা বিভাগীয় পরিসংখ্যান অফিসের যুগ্ম পরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘জরিপটি করা হয়েছে ‘স্মল এরিয়া এস্টিমেশন’ বা SAE পদ্ধতিতে। এতে হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (HIES) ও ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য ব্যবহার করে অত্যন্ত উন্নতভাবে মডেলিং করে উপজেলা ভিত্তিক দারিদ্র্যহার নির্ধারণ করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘এই পদ্ধতির মাধ্যমে ছোট ছোট এলাকার (উপজেলা) দারিদ্র্যের সুনির্দিষ্ট চিত্র উঠে এসেছে, যা নীতিনির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেবে।’
বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনেও দেখা মিলেছে দরিদ্রতার ভয়াবহ চিত্রের। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলে পরিবারভুক্ত নূর হোসেন মাঝি বলেন, ‘নদীভাঙনে জমিও নাই, জাল ফেলার মতো নদীও নাই। তিনদিন মাছ না ধরলে বাড়িতে চাল ফুরায়। সরকার কিছু দেয় শুনি, পাই না। এখন কাজ নাই, আয় নাই। দুইবেলা খাইতে পারলেই মনে হয় আল্লাহর রহমত।’
পৌর বা ইউনিয়ন শহর থেকে দূরে, যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, সেখানকার নারীরা আরও বেশি অসহায়। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ ধানসাগর গ্রামের গৃহবধূ জাহানারা বেগম বলেন, ‘তিনটা ছেলে-মেয়ে। লেখাপড়া তো দূরের কথা, খাবারই ঠিকমতো জোটে না। স্বামীকে নিয়ে বাজারে কাজে যাই, অনেক সময় শুধু একবেলার চাল কিনেই ফিরে আসি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আঞ্চলিক বরাদ্দে বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এবং টেকসই কর্মসংস্থানের অভাব এই দারিদ্র্যের মূল কারণ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশিকুর রহমান বলেন, ‘এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কোনো লক্ষ্যভিত্তিক উন্নয়ন হয়নি। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা সহায়তা বাড়াতে হবে।’
খুলনা বিভাগের অনেক এলাকায় নদীভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। মাছ ও ধানচাষে ক্ষতির মুখে পড়ছেন বহু কৃষক। এসব অঞ্চলের মানুষের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি জীবিকা অর্জনের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
উষা দাস, নূর হোসেন মাঝি, কিংবা জাহানারা বেগমের মতো মানুষের জীবন শুধু পরিসংখ্যান নয় তাদের জন্য দারিদ্র্য মানে প্রতিদিনের সংগ্রাম। প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূর করতে হলে দরকার শক্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত, যা শুধু কেন্দ্র নয়, উপজেলা পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, খুলনা বিভাগের গড় দারিদ্র্যহার ১৭.১ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ১৯.২ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২০:৪৮ ১৬ বার পঠিত